রাঙ্গামাটিতে ইউপি চেয়ারম্যানকে জনতার গণধোলাই

রাঙ্গামাটিতে ইউপি চেয়ারম্যানকে জনতার গণধোলাই 1চৌধুরী হারুনুর রশীদ (হারুন)রাঙ্গামাটি : ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও চেয়ারম্যান মো. রাসেল চৌধুরীর অত্যাচারে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার আমতলী ইউপি চেয়ারম্যানকে গণধোলাই দিয়ে হাসাপাতালে পাঠিয়েছে ইউনিয়নবাসী। তার অত্যাচারের শিকার শুধু এলাকার সাধারণ জনগণ নয়- ইউপি সদস্যসহ দলের তৃণমূলের সাধারণ নেতাকর্মীরাও। দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের এক পর্যায়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে ওই নেতাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছে বাঘাইছড়ির ছাত্রলীগের কর্মীরা। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে বাঘাইছড়ি উপজেলা সদরের জেলা পরিষদের রেস্ট হাউজের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি ও অনিয়মসহ নানা বেপরোয়া কর্মকান্ডে স্থানীয় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরীর ওপর ক্ষুব্দ ছিলেন ছাত্রলীগের স্থানীয় কর্মীরা। বৃহস্পতিবার দাফতরিক কাজে বাঘাইছড়ি উপজেলা সদরে যান রাসেল চৌধুরী। খবর পেয়ে তার ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে এলোপাতারি মারধর করে মাথা ফাটিয়ে আহত করে চলে যায় ক্ষুব্দ ছাত্রলীগ কর্মীরা। পরে উদ্ধার করে বাঘাইছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান পুলিশ ও স্থানীয়রা। ঘটনার পরপরই ১২ জনকে আসামি করে নিজে বাদী হয়ে বাঘাইছড়ি থানায় একটি মামলা করেন (নম্বর-১, তারিখ: ১৭/০৮/২০১৭) রাসেল চৌধুরী। এদের মধ্যে রতন দাশ (৩০) নামে একজনকে আটক করে পুলিশ।
রাঙ্গামাটিতে ইউপি চেয়ারম্যানকে জনতার গণধোলাই 2ঘটনার বিষয়টি নিশ্চিত করে বাঘাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমীর হোসেন জানান, একদল দুর্বৃত্তের হামলায় আহত রাসেল চৌধুরীকে বাঘাইছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। হামলাকারীরা নিজ দলীয় ছাত্রলীগের বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় রাসেল চৌধুরীর করা মামলায় রতন দাশ নামে একজনকে আটক করা হয়েছে। এদিকে ঘটনা সম্পর্কে জানতে রাসেল চৌধুরীর ব্যবহার করা মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাৎক্ষণিক কল রিসিভ করেননি তিনি।
এলাকার জনগণ জানান, স্থানীয় সুলতান মাস্টারের ছেলে মো. রাসেল চৌধুরীর ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অনিয়ম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজিসহ তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ এলাকার মানুষ। তিনি চেয়ারম্যান হয়েছেন পেশীশক্তি ও দলীয় প্রভাবে। তিনি একাধারে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং আমতলীবাজার চৌধুরী। বাজারের আগের চৌধুরী মো. মোবারক হোসেন চৌধুরীর কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেন তিনি। এতে রাসেল আহমেদ থেকে হয়েছেন রাসেল চৌধুরী। আর সেই রাসেল চৌধুরী এখন আমতলীবাসীর মুর্তিমান আতঙ্ক।
স্থানীয়রা জানান, রাসেল চৌধুরীর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দলীয় প্রভাবসহ ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ দিয়েছেন ইউপি সদস্য এবং এলাকার জনগণ। ক্ষতার জোরে নিরীহ মানুষের জমি বেদখল ও নারী নির্যাতনসহ অভিযোগ ভুরি ভুরি। কিন্তু তিনি ধরা ছোঁয়ার বাইরে। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি বরাবরে দেয়া অভিযোগের ভিত্তিতে এরই মধ্যে দলীয়ভাবে তদন্ত করা হয়েছে। তবে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত দেয়া হয়নি বলে জানান, তদন্ত কমিটির আহবায়ক ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জমির উদ্দিন। জেলা প্রশাসক বরাবরে ওয়ার্ড সদস্যদের দেয়া অভিযোগ তদন্তাধীন বলে জানান, বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তাজুল ইসলাম।
এ ছাড়া কয়েক দিন আগে বাঘাইছড়ি থানায় রাসেল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নিজে বাদী হয়ে নারী নির্যাতন মামলা করেন বলে জানান, আমতলী ইউনিয়ন মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এই ইয়াসমিন বেগম। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, বাঘাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমির হোসেন।
ওয়ার্ড সদস্য আবদুল মালেক, বাবর আলী, শহিদুল্ল্যাহ, সুবহান, মো. নূরতহিদ, রাবেয়া বেগম, ছালেহা বেগম ও নূর আয়েশা বলেন, চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে রাসেল চৌধুরীর অত্যাচারে এলাকার জনগণ শান্তিতে নেই। আমরাও অসহায়। প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে ভিজিডি, ভিজিএফ কার্ড দেয়ার নামে ৪০-৪৫ দুঃস্থ মানুষের কাছ থেকে ১০০০ হাজার টাকা বাধ্যতামূলকভাবে হাতিয়ে নিয়েছেন রাসেল চেয়ারম্যান। ভিজিডি ও ভিজিএফ কার্ডের বিপরীতে গ্রামীণ দুঃস্থ লোকজনকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে খাদ্য সহায়তা দেয় সরকার। কিন্তু এতে রাসেল চেয়ারম্যান প্রতি কার্ডে ১০০০ টাকা নিলেও কার্ড দিন প্রতি ওয়ার্ডে কেবল ১৫-২০ জনকে। বাকিদের কার্ডও নেই, টাকাও ফেরত নেই। শালিস বিচারের নামে উভয় পক্ষের কাছ মোটা অংকের টাকা নেন। এলাকার কোথাও বিয়ে হলে নিজস্ব বাহিনী নিয়ে বিয়ে বাড়িতে হাজির হয়ে বাল্য বিবাহের অভিযোগ তুলে হুমকির মুখে টাকা আদায় করেন। এ ছাড়া জমি ক্রয়-বিক্রয়ে এবং জেলেদের কাছ থেকে এককালীন ও মাসোহারা আদায় করেন। গরু, ছাগল থেকে শুরু করে ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর সব কিছুতে চাঁদা আদায় করেন তিনি। ৪০ দিনের কার্য কর্মসূচি, গুচ্ছগ্রাম, আরএমপি, এলজিএসপি, এডিপি, কাবিখা, কাবিটা, বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, বিধবা ভাতা, খেয়াঘাট, বোটঘাটসহ এমন কোনো কর্মসূচি বা প্রকল্প নেই- তিনি দুর্নীতি করেন না। প্রতি পদে পদে নিরীহ লোকজনকে হয়রানি করেন তিনি।
ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মাহিল্যা এলাকার বাসিন্দা মৃত মোবারক আলীর ছেলে জিয়াউল হক বলেন, কিছু দিন আগে ছেলে ঘরের নাতির বিয়ে দেন তিনি। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব মাস্তানবাহিনী নিয়ে বিয়ে বাড়ি গিয়ে হানা দেন রাসেল চেয়ারম্যান। তাৎক্ষণিক কিছু জানার আগেই কেন বাল্য বিয়ে দেয়া হচ্ছে এমন অভিযোগ তোলে আমাকে, নাতি ও নতুন বৌকে ধরে নিয়ে বেদম মারধর করেন রাসেল চেয়ারম্যান ও তার বাহিনী। এক পর্যায়ে নাতি ও তার বৌকে আটকে রেখে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে ওই দুই জনকে ছাড়িয়ে নিতে বলা হয়। অনেক কষ্ট করে ২৫ হাজার টাকা জোগাড় করে চেয়ারম্যানের হাতে দিয়েছি। কিন্তু তাতেও মানেন না। আমার গরু জোর করে বিক্রি করিয়ে দিয়ে গরু বেপারির কাছ থেকে আরও ২৫ হাজার টাকা গুনে নিয়েছেন চেয়ারম্যান। এরপর নাতি ও নাতির বৌকে ছেড়ে দেয়া হয়।
মৃত ইসমত সরদারের মেয়ে ইয়াসমিন বেগম (২৯) নামে তিন সন্তানের জননী স্থানীয় এক নারী বলেন, ঘর-সংসারসহ তার সব কিছু সর্বনাশ করেছেন রাসেল চেয়ারম্যান। তার কারণে এরই মধ্যে স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদও হয়েছে। তার এক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় আমাকে শারিরীকভাবে চরম নির্যাতন করে এলাকা ছাড়া করেছেন। এমনকি আমার শরীরে কাচা মরিচ বেটে মেখে নির্যাতন করেছেন ওই রাসেল। তার ভয়ে অনেক দিন ঢাকায় গিয়ে অবস্থান করি। ৬ আগষ্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছি তার বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দা বাবুল মিয়ার স্ত্রী আকলিমা বেগম (৫০) জানান, কথা না মানায় তার ছেলে আবদুল করিমের (২৫) বিরুদ্ধে মিথ্যা বন মামলা দিয়েছেন রাসেল চেয়ারম্যান। গ্রামের কারবারি ইউসুফ আলী (৬২) বলেন, রাসেল চেয়ারম্যানের হুমকিতে এলাকায় আতঙ্কে বাস করতে হচ্ছে তাকে। মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাশেম (৭৫) বলেন, ক্ষমতার জোরে তার জমি বেদখল করেছেন রাসেল চেয়ারম্যান।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে কয়েক দিন আগে ফোনে যোগাযোগ করা হলে আমতলী ইউপি চেয়ারম্যান মো. রাসেল চৌধুরী বলেন, সব অভিযোগ মিথ্যা ও কাল্পনিক। এসবই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তাদের দুর্নীতির বিষয়ে সতর্ক করে দেয়ায় কতিপয় ওয়ার্ড সদস্যসহ এলাকার কুচক্রীরা আমার ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে চাচ্ছে। তাদের ষড়যন্ত্রের বিষয়ে মানহানির মামলা দেয়া হয়েছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!