রড ছাড়া ছাদ/ কোটি টাকার কাজ যেভাবে ভাগাভাগি হল গোপনে

বাঁশখালীতে সাইক্লোন শেল্টারের সংস্কারকাজ

বাঁশখালীতে কোটি টাকার কাজ গোপনে ভাগাভাগি হয়েছে অভিনব কৌশলে। জুন মাসের মধ্যে কাজ শেষ না হলে বরাদ্দ হওয়া অর্থ ফেরত যাবে—এ অজুহাতে বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে নয়টি আশ্রয়কেন্দ্রের সংস্কার কাজের ভার তুলে দেওয়া হয়েছে একটি সিন্ডিকেটের হাতে। অনিয়মে ভরা পুরো প্রক্রিয়াটির তত্ত্বাবধান করেছেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) স্বয়ং। কাজও পেয়েছেন তার পছন্দসই ঠিকাদাররা।

যেসব সাইক্লোন শেল্টার ঘিরে অনিয়ম
বাঁশখালীর ছনুয়ায় মোট তিনটি সাইক্লোন শেল্টার—৯ নং ওয়ার্ডে নোয়াপাড়া প্রশিকা সাইক্লোন শেল্টার, ৭নং ওয়ার্ডে তোতকখালী রেড ক্রিসেন্ট সাইক্লোন শেল্টার ও ৮নং ওয়ার্ডে খুদুকখালী রেড ক্রিসেন্ট। বাহারছড়ায় মোট দুটি সাইক্লোন শেল্টার—১নং ওয়ার্ডের উত্তর বাহারছড়ায় ওসমান মেম্বারের বাড়ির সামনের সাইক্লোন শেল্টার ও ৩নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ রত্নপুর বুইদ্দার বাড়ির সাইক্লোন সেল্টার। গন্ডামারায় এস.আলম পাওয়ার প্ল্যান্টের পাশের সাইক্লোন শেল্টার। সরলে আমিন চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশের সাইক্লোন শেল্টার। খানখানাবাদে হীড বাংলাদেশের সাইক্লোন শেল্টার। শীলকূপে বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয় সাইক্লোন শেল্টার।

এই নয়টি সাইক্লোন শেল্টারের সংস্কারকাজের জন্য মোট এক কোটি ১০ লাখ টাকার কাজের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে নয়টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যে দুটির কার্যাদেশ ৫ লাখ টাকা করে এবং অপর সাতটি ১০ টাকা লাখ করে।

যেভাবে হয়েছে অনিয়ম
নিয়ম অনুসারে বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রে এই কাজের দরপত্র আহ্বান করার কথা থাকলেও তা না করে উপজেলা প্রশাসন দরপত্র আহবান করেছে অত্যন্ত গোপনে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার পছন্দসই ঠিকাদারকে কাজটি পাইয়ে দিতেই মূলত এই গোপনীয়তার আশ্রয় নেওয়া হয়। তাতে ফলও মিলে হাতেনাতে। পুরো প্রকল্পের কোটি টাকার কাজ হাতিয়ে নেয় ছয়টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। শুধু তাই নয়, গত মে মাসের শেষ দিকে পুরো সিন্ডিকেটকে কার্যাদেশও দিয়ে দেওয়া হয় তড়িঘড়ি। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবুল কালাম মিয়াজী অবশ্য দাবি করেছেন, নিয়ম মেনে সব কাজের টেন্ডার হয়েছে। কার্যাদেশও সেভাবেই দেওয়া হয়েছে।

কাজ নয়, বিলই লক্ষ্য
জানা যায়, দ্রুত বিল বুঝে নেওয়ার জন্য কার্যাদেশ পেয়েই কাজও শেষ করে ফেলে বিস্ময়করভাবে। অথচ দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো কাজই করা হয়নি। সামান্য কিছু কাজ করলেও তা খুবই হেলাফেলায়। বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয় সাইক্লোন শেল্টারে দেখা গেছে, ঠিকাদাররা ছাদের ওপর ঢালাই ও নিচের ফ্লোরে কোনো রড ব্যবহার করেনি। সাধারণ ঢালাই দিয়ে কাজ শেষ দেখিয়েছে। ছয়টি জানালার ওপর হালকা প্রলেপ লাগিয়ে ‘সংস্কার’ দেখিয়েছে। বাহারছড়ায়ও দেখা গেছে একই অবস্থা। ইচ্ছেমতো খণ্ড খণ্ডভাবে প্লাস্টার করা হচ্ছে। রঙও করা হচ্ছে খেয়ালখুশিমতো। ছনুয়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাইক্লোন শেল্টারটি ‘সংস্কারকাজ’ চলার পরও আগের মতোই জরাজীর্ণ রয়ে গেছে। ছনুয়া ইউনিয়নের তোতকখালী রেড ক্রিসেন্ট আশ্রয়কেন্দ্রে চারটি পিলারের আস্তরণ তুলে পুনরায় আস্তর করা হয়েছে। নিচের ফ্লোর ঢালাই দিয়েছে।

জানা যায়, তড়িঘড়ি ‘কাজ শেষ’ করে চলতি জুনের মধ্যেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্বাক্ষরে কাজের বিল নিতেও তৎপর ছিল তারা। তবে কাজ চলমান থাকাবস্থায় একটি বিল তুলে ফেলা হয়েছে বলে জানা গেছে।

ছয় ঠিকাদারের সিণ্ডিকেট
পুরো প্রকল্পের কোটি টাকার কাজটি ভাগিয়ে নেওয়া ছয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এসএস কর্পোরেশনের লাইসেন্সে কাজ করছেন নীলকন্ঠ দাশ। আর আহমদ চৌধুরী লাইসেন্সের মালিক সরল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রশিদ আহমদ চৌধুরী। অথচ স্থানীয় সরকার আইনে কোনো চেয়ারম্যান বা জনপ্রতিনিধি সরাসরি ঠিকাদারি কাজে যুক্ত হতে পারেন না। কিন্তু রশিদ আহমদ চৌধুরী আইনকে তোয়াক্কা না করে নিজের লাইসেন্সে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে।
রনি এন্টারপ্রাইজের লাইসেন্সও আবার সরল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রশিদ আহমদ চৌধুরীর ছেলের নামে। ছেলে সরাসরি ঠিকাদারিতে যুক্ত না হলেও এই লাইসেন্সে মূলত তার বাবাই কাজ করেন বলে জানা গেছে।
কার্যাদেশ পাওয়া হামিদ এন্টারপ্রাইজের মালিক পৌরসভা যুবলীগের আহবায়ক হামিদ উল্লাহ। উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক শ্যামল কান্তি দাশ কাজ পেয়েছেন সুজাত এন্টারপ্রাইজের নামে।
জানা যায়, সবকিছুর তদারকিতে আছেন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম।

নিম্নমানের কাজে ক্ষোভ, দুদকে চিঠি
কাজে অনিয়ম ও বরাদ্দ অনুসারে কাজ না হওয়ায় এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ। তারা অভিযোগ করেছেন, বরাদ্দ অনুযায়ী তেমন কোনো কাজই হয়নি। এমনিতেই দরপত্রের পুরো কাজ হয়েছে অনিয়মের মাধ্যমে। এর ওপর কাজ না করেই ঠিকাদার সিণ্ডিকেট বিল তোলার চেষ্টায় মরিয়া। গত ২৩ জুন অনিয়মের তদন্ত চেয়ে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বরাবরে একটি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে। বাহারছড়ার নাছির উদ্দিন নামে এক ব্যক্তি নিম্নমানের কাজ এবং কাজের দরপত্র আহবান থেকে শুরু করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রচার নিয়ে নানা অভিযোগ তুলে জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করেছেন।

বঙ্গবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো.ওমর ফারুক বলেন, ‘ঠিকাদাররা ছাদের ওপর ঢালাই ও নিচের ফ্লোরে একটি রডও ব্যবহার করেনি। ঢালাইও হয়েছে নিম্নমানের। জানালা সংস্কারের কাজেও হেলাফেলা করা হয়েছে। অথচ শুনছি এই সাইক্লোন শেল্টারের কাজ নাকি শেষের পথে।’

ছনুয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা মুজিবুল হক চৌধুরী বলেন, ‘৭ নম্বর ওয়ার্ডের ক্ষতিগ্রস্থ ভবনটি আগের মতোই জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়ে গেছে। বাকি দুটি সাইক্লোন শেল্টারের সংস্কার কাজও কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে শেষ করা হয়েছে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!