শিক্ষকের মাথায় কেরোসিন/ ‘যৌন হয়রানি’র সেই ঘটনায় আবার উত্তপ্ত ইউএসটিসি

চট্টগ্রামের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (ইউএসটিসি) ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির অভিযোগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবারও তোলপাড় ইউএসটিসি ক্যাম্পাস। গত ২২ এপ্রিল ইংরেজি বিভাগের ২২ জন শিক্ষার্থীর অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করে। ইউএসটিসি কর্তৃপক্ষের তদন্তে অভিযোগের সত্যতা না মিললেও পুলিশ প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদন এখনও পাওয়া যায়নি।

এ অভিযোগের সুরাহা না হওয়ায় কিছু শিক্ষার্থী মঙ্গলবার (২ জুলাই) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে ঘন্টাব্যাপী সড়ক অবরোধ করেন এবং অভিযুক্ত শিক্ষকের মাথায় কেরোসিন ঢেলে হত্যার চেষ্টাও করেন।

অভিযুক্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. মাসুদ মাহমুদের পরিবার এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, ক্লাস শেষে চেয়ারম্যানের রুমে ছিলেন অধ্যাপক ড. মাসুদ মাহমুদ। কথা শেষে রুম থেকে অপর একজন শিক্ষক আবদুর রশিদসহ বের হয়ে লিফটে উঠতে গেলে ওই শিক্ষার্থীদের কয়েকজন ‘ধর ধর, ধাক্কা দে, ধাক্কা দে’ বলে তাঁর পিছু নিয়ে লিফটের ভেতরে যান। এর মধ্যে দুজন তাঁকে ধাক্কাও দিয়ে বসেন। আতঙ্কিত হয়ে অপর শিক্ষক আবদুর রশিদ লিফটে না উঠে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামেন। লিফটে অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে কয়েকজন শিক্ষার্থী আগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষককে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘‘মেয়েদের ইনসাল্ট করেছেন, রেপ (ধর্ষণ) করার কথা বলেছেন। আপনাকে সবার সামনে ক্ষমা চাইতে হবে।’ এসব কথা বলে তারা জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করার চেষ্টা করলে একপর্যায়ে শিক্ষক মাসুদ মাহমুদ চুপ করে থাকেন। ততক্ষণে লিফট নিচে চলে আসলে ওই শিক্ষকের শার্টের কলার চেপে ধরে তারা বাইরে নিয়ে আসেন। শিক্ষকের হাতে থাকা দুটো বই কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারেন শিক্ষার্থী অনিক। পরে ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান শিক্ষকের মাথায় কেরোসিন ঢেলে দেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিন ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস, শাহনাজ, ডলি মন্তব্য করেন শিক্ষকের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিতে। তবে পরক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা এসে অধ্যাপক ড. মাসুদ মাহমুদকে রক্ষা করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে টায়ার জ্বালিয়ে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন। এ সময় প্রায় একঘণ্টা ওই সড়কে যানচলাচল বন্ধ থাকে। পরে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে চলে যান এবং সেখানে বিক্ষোভ করেন। এ সময় শিক্ষকের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়ার অভিযোগে মাহমুদুল হাসান নামে এক শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার দিলীপ কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘কিছু শিক্ষার্থী অধ্যাপক ড. মাসুদ মাহমুদকে লিফট থেকে টেনে বের করে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। খুলশী থানায় একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছে। যেসব শিক্ষার্থী মাসুদ মাহমুদ স্যারের সঙ্গে এমন আচরণ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরিকল্পনা করেই তারা এমন আক্রমণ করেছে। অফিস থেকে নিয়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়েছে। না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেরোসিন আসবে কোথা থেকে?’

তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ‘আজ অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ লিফটে ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের কয়েকজন ছাত্রীকে ‘ধর্ষণের হুমকি’ দেন। এর প্রতিবাদেই তারা সড়ক অবরোধ করেন।’

এ প্রসঙ্গে ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাশেদুন্নবী বলেন, ‘সকালে ক্যাম্পাসে এলে চারতলায় হইচই শুনে আমি সেখানে যাই । গিয়ে দেখি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাসুদ মাহমুদ স্যারের তর্কবিতর্ক চলছে। মাস্টার্সের কয়েকজন আপু এ ও অভিযোগ করেন, মাসুদ মাহমুদ স্যার আজকে লিফটে তাদের ধর্ষণ করার হুমকি দিয়েছেন। এই ঘটনার কারণেই শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন।’

অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তারা বলেন, ‘হয়তো স্যারের গায়ে কেরোসিনের ছিটা পরেছে।’

একই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘যে ছেলেটি ঘটনা ঘটিয়েছে সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নিচ্ছে। তাছাড়া এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাঁরা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবেন। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে ঘটনার খবর পেয়ে নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাক ঘটনাস্থলে গিয়ে ইউএসটিসি’র উপাচার্যসহ শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন।

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঘটনায় মামলার প্রেক্ষিতে ওই শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। গত এপ্রিলের অভিযোগে তদন্ত প্রতিবেদনের অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রিপোর্ট প্রায় শেষ পর্যায়ে। পেলে জানাবো।’ ঘটনার সত্যতা কতটুকু-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তদন্ত শেষ না হওয়ায় এখন বলতে পারছি না।’

খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রণব চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষকের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়ার ঘটনায় মাহমুদুল হাসানকে ক্যাম্পাস থেকে আটক করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মাহমুদুল হাসান শিক্ষকের গায়ে কেরোসিন ঢালার বিষয়টি স্বীকার করেছে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি।’

তবে অধ্যাপক ড. মাসুদ মাহমুদের দাবি, ‘ইংরেজি বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি কয়েকজন শিক্ষককে চাকুরিচ্যুত করেন। এরপর তাদের ইন্ধনে শিক্ষার্থীদের একাংশ তার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ তুলতে থাকেন।’

অধ্যাপক ড. মাসুদ মাহমুদের স্ত্রী নাছিমা আকতার বলেন, ‘তিনি (মাসুদ মাহমুদ) এত বছর ধরে শিক্ষকতা করে আসছেন, কেউ বাজে মন্তব্য করতে পারেনি অথচ শেষ সময়ে এমন ঘটনা মানা যায় না। যত কিছুই হোক না কেন এটা বিচার করার ক্ষমতা তো ওদের কাছে নেই। আসলে আমরা এটা নিয়ে কোনো কিছু (আইনি সহায়তা) করিনি। থেমে যাওয়াতে আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।’

তিনি যোগ করেন, ‘চাকরিচ্যূত কয়েকজন শিক্ষক উনাকে (মাসুদ মাহমুদ) সরাসরিই বলেছেন ‘‘আপনি এখান থেকে চলে যান না হলে পরিণতি খারাপ হবে।’ কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘কত করে বললাম চলে আসতে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অনুরোধে তিনি রয়ে গেলেন। আর আজকের এই ঘটনা দেখতে হলো।’

ইউএসটিসির প্রক্টর কাজী নূরে আলম সিদ্দিকী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন,‘আগে থেকে কিছু দাবিদাওয়া এবং ইংরেজি শিক্ষক মাসুদ মাহমুদের সাথে ব্যক্তিগত অভিযোগের জেরেই এমন ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করেছে। রিপোর্ট এলেই আসল কারণ জানা যাবে।’

আগের অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদনের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আগের অভিযোগের সত্যতা মেলেনি।’

প্রায় ৪০ বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পর তিন বছর আগে ইউএসটিসির ইংরেজি বিভাগে যোগ দেন অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ। সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শ্রেণিকক্ষে ‘অপ্রাসঙ্গিকভাবে’ যৌনতা বিষয়ে তুলে ধরে পক্ষান্তরে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করেছেন তিনি। গত ২২ এপ্রিল এ বিষয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীকে একটি স্মারকলিপিও দেন তাঁরা। সেখানে ইংরেজি বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে অধ্যয়ন করা ২৬৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে ২২ জনের সই ছিল।

তবে শুরু থেকেই যৌন নিপীড়নের অভিযোগটি উদ্ভট ও সত্য নয় বলে দাবি করে আসছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ। মাসুদ মাহমুদের পক্ষে মাঠে নামেন চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনেরা। পাশাপাশি এই অধ্যাপকের চরিত্রহননের অপচেষ্টা চলছে উল্লেখ করে এর প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেন দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের ৫০৭ বিশিষ্টজন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর মাসুদ মাহমুদ ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার মান উন্নত করার লক্ষ্যে কয়েকজনকে চাকরিচ্যূত করেন এবং নতুন কয়েকজনকে নিয়োগ দেন। পাশাপাশি ইংরেজি বিভাগের বেশ কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী ক্লাস উপস্থিতি বিবেচনায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা হারান। চাকরিচ্যূত ওই শিক্ষকদের ইন্ধনে এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ হারানো শিক্ষার্থীরাই মিলে অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন বলে জানান তাঁরা।

এসআর/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!