যৌথ প্রযোজনার কেমন নীতিমালা চান তারকারা?

যৌথ প্রযোজনার কেমন নীতিমালা চান তারকারা? 1বিনোদন প্রতিদিন : সিনেমাপাড়ায় এখন প্রশ্ন উঠেছে কেমন হওয়া উচিত যৌথ প্রযোজনার নতুন নীতিমালা? ১৯৮৬ সালের নীতিমালায় বলা আছে, যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণে নির্মাতা, শিল্পী, কলাকুশলী দু’দেশ থেকে সমহারে থাকতে হবে। দু’দেশে শুটিং হতে হবে। কিন্তু ২০১২ সালের পরিবর্তিত নীতিমালায় উল্লেখ আছে দু’দেশের নির্মাতা আলোচনার ভিত্তিতে সব বিষয় চূড়ান্ত করবে। নির্মাতারা বলেন, আসলে এটি শুভঙ্করের ফাঁকি ছাড়া আর কিছুই নয়। এরপর ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই যৌথ প্রযোজনায় চলচ্চিত্র নির্মাণ নীতিমালা (২০১২ সংশোধিত) জারি করা হয়।

নতুন নীতিমালা নিয়ে কিংবদন্তি অভিনেত্রী চিত্রনায়িকা সুচন্দা বলেন, ‘দুই দেশের তারকা শিল্পীদের এক মঞ্চে হাজির করতে, নতুন স্বাদ যোগ করতে যৌথ আয়োজনে চলচ্চিত্র নির্মাণ হতেই পারে। এটি আগেও হয়েছে। কিন্তু নীতিমালা যদি সঠিক না হয়, তাহলে উভয় পক্ষেরই ক্ষতি হবে। যারা নীতিমালা নির্ধারণ করবেন তারা যেন অবশ্যই এটা বিবেচনা করেন। নইলে চলচ্চিত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। পাশাপাশি সাফটা চুক্তি ও হলের পরিবেশ ইতিবাচক করতে শুনছি তথ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই সরকারকে চলচ্চিত্রের এই দুর্দিনে আন্তরিকতা নিয়ে পাশে দাঁড়ানোর জন্য।’

ববিতা বলেন, ‘আমি যৌথ প্রযোজনার বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছি। এবং প্রযোজনাও করেছি। আমি যৌথ প্রযোজনার পূর্ণাঙ্গ নিয়ম মেনেই করেছি। সমানসংখ্যক শিল্পী-কলাকুশলী, আমার দেশের সঙ্গে মানানসই গল্প, সমান হারে শুটিং করেছি। পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারছি এখন এসবের কিছুই মানা হয় না। উদ্ভট গল্প, পুরো ছবি দেশের বাইরে শুটিং করে এনে বাংলাদেশে একটা গান আর দু-তিনটা দৃশ্যধারণ করে ছবি মুক্তি দেয়া হচ্ছে। এটা স্রেফ জালিয়াতি। যারা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন আমিও তাদের একটি অংশ। শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে গিয়েছি। আমার চাওয়া থাকবে যৌথ প্রযোজনায় ছবি নির্মিত হলে যেন দুদেশের সবকিছুর অনুপাত সমান থাকে। দুই দেশের সম্মানও সমুন্নত থাকে।’

চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘যৌথ প্রযোজনার নামে যেটা হচ্ছে সেটা বেদনাদায়ক। নব্বই ভাগ শিল্পী আসছে ইন্ডিয়া থেকে এবং আমাদের দেশ থেকে নামমাত্র দশভাগ শিল্পী কাজ করছে। এটা না হয়ে যেন ফিফটি-ফিফটি থাকে। এছাড়া ইন্ডিয়াতে যখন ছবিটা রিলিজ হচ্ছে সেখানে আমাদের দেশের পরিচালকের নাম থাকে না, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম থাকে না। এটা ঠিক না। এখন নতুন নীতিমালা এমনভাবে তৈরি করা উচিৎ যেন দুদেশের চলচ্চিত্রের স্বার্থরক্ষা করা যায়। যেটাই নীতিমালাতে আসুক না কেন মূল এই বিষয়টি থাকা উচিৎ।

পুরাতন নীতিমালায় এই ফিফটি-ফিফটি হিসেব থাকে তারপরেও যদি না মানা হয়, তবে আমাদের দেশে সেসব ছবি মুক্তি পায় কেন? সেন্সরবোর্ড এটা দেখেই মুক্তি দেয়া উচিৎ। আর নীতিমালা তৈরি বা সংশোধন মূখ্য বিষয় নয়, সেটা মানা হচ্ছে কি না তা মনিটরিং করতে হবে। আর সাফটা চুক্তি নিয়েও সরকারের নজরদারি খুব প্রয়োজন।’

অভিনেত্রী জয়া আহসান বলেন, ‘এখনকার যৌথ প্রযোজনার ছবিগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় কতটুকু নিয়ম মেনে নির্মাণ করা হচ্ছে। সমানসংখ্যক কলাকুশলী নিয়ে ছবি নির্মাণ করার কথা থাকলেও তা কেউ করছেন না। সেন্সর বোর্ডের যৌথ চলচ্চিত্র নির্মাণ সংক্রান্ত নীতিমালার ৬নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ছবির জন্য মুখ্য শিল্পী ও কলাকুশলীর সংখ্যা যৌথ প্রযোজকগণই নির্ধারণ করবেন। এক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের কলাকুশলীর সংখ্যানুপাত সাধারণভাবে সমান রাখতে হবে। একইভাবে চিত্রায়ণের লোকেশন সমানুপাতিক হারে রাখতে হবে। এই নিয়ম মানা বাধ্যতামূলক করা হোক।

দুই দেশ মিলে যদি যৌথ প্রযোজনা করা যায় তাহলে খুব ভালো। তবে এ ক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতাও আছে। আমরা যেহেতু একটা দেশ, আর কলকাতা ভারতের একটা রিজিয়ন তাই অনেক ফাঁকফোকর থেকে যায়। এটা খুবই দুঃখজনক। সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন। আমাদের এখান থেকে যেসব সিনেমা কলকাতায় যাচ্ছে, ওখানে কেউই সেগুলো দেখছে না। প্রযোজক পর্যায় থেকেও কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। শুধু শুধু যৌথ প্রযোজনা আর সাফটা চুক্তি। সরকার আন্তরিক হচ্ছে শুনে খুব ভালো লাগছে।’

চিত্রনায়ক বাপ্পী বলেন, ‘আগে বলতে চাই সাফট চুক্তি নিয়ে। এটা আপাতত বাদ দেয়া উচিৎ। কলকাতার চলচ্চিত্র বাজারের অবস্থা ভালো না। আমাদের ছবির তুলনায় তাদের ছবির বাজেট বেশি হওয়ার পরেও ছবিগুলো সেখানে ভালো চলছে না। সেটা তাদের পত্রিকা ও সিনিয়রদের সাক্ষাতকার পড়লেই বুঝা যায়। কলকাতা রঙচঙ দিয়ে নিজেদের দৈন্যতার বিষয়টি ঢেকে রাখছে। কৌশলী ওরা। তাই তারা সাফটা চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের বাজার ধরতে চাচ্ছে।

আর যৌথ প্রযোজনায় ছবি যদি নির্মিত হয়, তাহলে সঠিকভাবে ফিফটি-ফিফটি অনুপাতে হতে হবে। শিল্পী, শুটিং লোকেশন, টেকনিশিয়ান সবকিছুই সমান সংখ্যক হবে। এই নিয়মকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। নীতিমালা এমনভাবে হোক যাতে করে যৌথ প্রযোজনায় উৎসাহ না দেয়া হয়। এতে করে লোকাল প্রডাকশনে বেশি বেশি ছবি নির্মাণ হবে। যে গাছে দু’দিন পরপর পঁচন ধরে সে গাছ রাখার চেয়ে কেটে ফেলা উচিৎ। মানে যে নীতিমালা মানাই হচ্ছে না সেটা রাখার দরকারই নেই। যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ দুই-তিন বছরের জন্য বন্ধ করে দেয়া হোক। আগে আমরা নিজেরা দাঁড়াই। যেহেতু মেঘ কাটতে শুরু করেছে আমার বিশ্বাস সবকিছু ঘুরে দাঁড়াবে।

আর আমি মনে করি আমাদের মূল সমস্যা হলের জিম্মিদশা। প্রযোজকরা ছবি মুক্তি দেয়ার রাজনীতি থেকে রক্ষা পেলে ছবি নির্মাণে উৎসাহী হবে। দেশের মানুষ প্রচুর ছবি দেখে। কিন্তা তারা হলের পরিবেশ না পেয়ে আসেন না। তাই ৬৪ জেলায় ২টি করে সিনেপ্লেক্স চাই আমরা যার নিয়ন্ত্রণ থাকবে সরকারের হাতে কিংবা বিশ্বস্ত কারো কাছে।’

সংগীত পরিচালক ইমন সাহা বলেন, ‘আমাদের সরকার আমাদের সবকিছু বিবেচনা করেই নীতিমালা বানাবেন বলে মনে করি। কারণ আমাদের জন্য অমঙ্গলকর কোনোকিছু সরকার করেননি আর করবেনও না বলে আমি বিশ্বাস করি। সরকার যে নীতিমালা নির্ধারণ করবেন সেটা আমাদের বিপক্ষে যায় না, আমরা মানি কি মানি সেটা আমাদের ব্যাপার। বিভিন্ন ফাঁকফোকর বের করে আমরা এখানে অনিয়ম ঢুকাই। আমি ‘চুড়িওয়ালা’ নামের যৌথ প্রযোজনার ছবিতে কাজ করেছি, আমার বাবাও ছিলেন। আমি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করেছিলাম, বাবা গান করেছিলেন। মিউজিকের টেকনিশিয়ানরা বাংলাদেশের ছিলো, সিঙ্গাররা সেদেশের ছিলো। সমান অনুপাত ছিল। তখন নিয়ম ভাঙার ব্যাপার ছিলো না। আমি যৌথ প্রযোজনার প্রায় ৪০টি ছবির সংগীতের কাজ করেছি। আমি কখনোই এখানে অনিয়ম চাই না।

আর সাফটা চুক্তি নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হচ্ছে। দেখুন আগেই বলেছি সরকার আপনাদে সুবিধা দেয় ভালোর জন্য। আপনি যদি তাকে অপব্যবহার করেন তার দায় রাষ্ট্রের নয়। চলচ্চিত্র শুধু পণ্য নয়, এটা ব্যবসায়েরও জায়গা।’

অর্থনীতিবিদদের মতে যৌথ প্রযোজনার নামে মূল প্রতারণা হয় আর্থিক খাতে। অর্থ পাচারে এরচেয়ে সহজ মাধ্যম এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। যৌথ প্রযোজনার আড়ালে ভয়াবহ রকম অর্থ পাচার করা হচ্ছে বলেই অনেক চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের অভিযোগ। দেশপ্রেম তথা দেশের চলচ্চিত্রের প্রতি শ্রদ্ধা কিংবা ভালবাসা জলাঞ্জলি দিয়ে এসব প্রযোজক-নির্মাতারা দেশের সংস্কৃতিবিরোধী, সর্বোপরি দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। যতো দ্রুত সম্ভব এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তথ্য, অর্থ, বাণিজ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন চলচ্চিত্রপ্রেমীরা।

পাশাপাশি সাফটা চুক্তির সঠিক ব্যবহার, হলের সমস্যা দূরীকরণ রোধ করতে পারলে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেও প্রত্যাশা নানা প্রজন্মের চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলীদের।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!