যে কারণে মাছ কমে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে

গভীর সমুদ্রে অনিয়ন্ত্রিত অতি আহরণ, বেপরোয়া ট্রলিং, পোনা নিধন, ক্ষুদ্র ফাঁসের নিষিদ্ধ সব জালের ব্যবহারের কারণে ক্রমশ মাছশুন্য হয়ে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগর। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে বঙ্গোপসাগরের একসময়ের মৎস্যভান্ডার।

ডিপ সি ট্রলিংয়ে করে বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্রাতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, মাছ শিকারে ‘পেডিকোট’ জাল ব্যবহারসহ নানান কারণে দিন দিন কমে যাচ্ছে সাগরের মৎস্য ও জলজ প্রাণীর প্রজাতি। এসবের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ না থাকায় গাণিতিক হারে কমতে কমতে এখন শেষ হয়ে আসছে সাগরের মৎস্যভান্ডার। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় থাইল্যান্ডের ‘গালফ অব থাইল্যান্ড’ সাগরের মতো বঙ্গোপসাগরও মৎস্য শুন্য হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন মৎস্য বিজ্ঞানী ও গবেষকরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, নানান কারণে বঙ্গোপসাগরের মৎস্যভান্ডার হুমকির মুখে পড়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ‘গালফ অব থাইল্যান্ড’-এর পরিস্থিতি বরণ করে মাছ শুন্য হয়ে পড়বে বঙ্গোপসাগর।

এ পরিস্থিতি উত্তরণে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে একটি পরিকল্পিত ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট তৈরি করতে হবে। যাতে মৎস্যখাত সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এছাড়া সাগর থেকে মাছ আহরণ ও ফিশিং ট্রলারের সংখ্যা কমাতে হবে।
বঙ্গোপসাগরের মৎস্যভান্ডারের ওপর গবেষণা চালাতে সামুদ্রিক মৎস্য অধিদফতর ‘বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। ওই প্রকল্পের আওতায় গত দুই বছর ধরে বঙ্গোপসাগরে গবেষণা চালাচ্ছে ‘আরভি মীন সন্ধানি’ নামক অত্যাধুনিক রিসার্স ভ্যাসেল।

ওই গবেষক দলের ক্রুজ লিডার অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান চৌধুরী বঙ্গোপসাগরের বর্তমানের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। তার দেওয়া তথ্য মতে, আরভি মীন সন্ধানি জাহাজ থেকে গবেষণার অংশ হিসেবে গত দুই বছরে ৩২০ বার সাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে জাল ফেলা হয়। এসময় ৪০২টি প্রজাতির মাত্র ৬ টন মাছ ধরা পড়ে। যার মধ্যে ৩১১টি প্রজাতির মাছ মাত্র ৫ বার পাওয়া গেছে। ৩১১টি প্রজাতিই ওজন ছিল আধা কেজির কম। এসময় দেখা যায় সাগরে আহরণযোগ্য মাছের প্রজাতি রয়েছে সর্বোচ্চ ৫০টি!
৩২০ বার জাল ফেলে মাত্র একটি লাক্ষ্যা মাছ পাওয়া যায়। প্রত্যেকবারে লইট্টা, ছুরি, রঙ্গিল, রূপচান্দা, সুরমা ও কাউয়াসহ ছোট প্রজাতির মাছগুলো বেশি আসে। অপরদিকে কোরাল, লাক্ষ্যা, বড় সুরমাসহ দামি ও বড় মাছগুলো পাওয়া যাচ্ছে কম। অথচ ১৯৮০ সালে সাগরে একই পরিমাণ জাল ফেলা হলে আহরণ করা যেত কমপক্ষে ৬০০ টন মাছ। পাওয়া যেত কোরাল, লাক্ষ্যা, সুরমাসহ বড় প্রজাতির মাছ। ওই সময় সাগরে মাছের প্রজাতিও ছিল ৪৭৫টি।

গবেষকদের মতে, বঙ্গোপসাগরে হঠাৎ করে সাডিন মাছের পরিমাণ বেড়েছে। সাডিন মাছ বেড়ে যাওয়াতে কোনো খুশির খবর নেই। বরং এটা দুঃসংবাদ। কারণ সাডিন মাছকে অন্য যে মাছগুলো খেত, সেগুলো হয়তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অথবা পরিমাণে কমে গেছে। তাই সাডিনের সংখ্যা বেড়ছে সাগরে।
জানা যায়, মাত্রাতিরিক্ত মৎস্য আহরণের কারণে থাইল্যান্ডের ‘গালফ অব থাইল্যান্ড’ মাছশূন্য হয়েছে। থাইল্যান্ডে ১৯৬০ সাল থেকে অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ শুরু হয়। তখন একটি ট্রলারে করে একঘণ্টা মৎস্য আহরণ করলে মাছ পাওয়া যেত ২৭০ কেজি। ১৯৯০ সালে যা কমে হয় মাত্র ১৮ কেজি। ২০১৮ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র এক কেজি। ‘গালফ অব থাইল্যান্ড’-এর একই পরিণতি ঘটতে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরে। ১৯৮৭-৮৮ সালে যে মাছ পাওয়া যেত বর্তমানে তার ১০ ভাগের এক ভাগ মাছ পাওয়া যায়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান চৌধুরী আরও বলেন, মাছ হচ্ছে বঙ্গোপসাগরের একমাত্র সম্পদ। যে সম্পদ বাচ্চা দেয়। তাই এ সম্পদের দিকে নজর দিতে হবে। এটি একমাত্র সামুদ্রিক সম্পদ যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভোগ করতে পারবে।
তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ও বিশ্বব্যাংক বঙ্গোপসাগরের জন্য বড় একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যা জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছর এ সেক্টরের ম্যানেজমেন্টগুলো উন্নত করবে। এছাড়া কক্সবাজার সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর, মহেশখালী চ্যানেল, সোনাদিয়া চ্যানেল, সব নদ-নদী মোহনা, খাঁড়ি ও উপকূল সংলগ্ন প্যারাবনের বাইরে পেতে রাখা হয়েছে অবৈধ-নিষিদ্ধ চরজাল, বিহিঙ্গি জাল ও কারেন্ট জালসহ অন্যসব অননুমোদিত জাল। আর এসব জালে মরা পড়ছে রকমারি প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণীর পোনা। সমুদ্রগামী ফিশিংবোটগুলোও ব্যবহার করছে নিষিদ্ধ এসব জাল। ফলে উপকূল কিংবা সাগর, কোনখানেই বাঁচার উপায় নেই মাছের পোনাদের।

সাধারণত গভীর সমুদ্রে প্রজননের পর মাছের নিষিক্ত পোনাগুলো ঢেউয়ের ধাক্কায় উপকূলের কাছাকাছি অগভীর পানিতে চলে আসে। সেখানে চর অথবা প্যারাবনই তাদের জন্য প্রাকৃতিক নার্সিংগ্রাউন্ড। শৈশবের নির্দিষ্ট একটা সময় এখানে কাটিয়ে আবারো গভীর সাগরে ফিরে যায় তারা। কিন্তু এখানেই নিধনের শিকার হয়ে আর সাগরে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পায় না পোনা মাছের সব প্রজাতি। কারণ, চরজাল ও খুঁটিজালের থাবায় এই স্থানগুলোও বিপর্যস্থ। ফলে শৈশবেই বেঘোরে নিধন হচ্ছে মৎস্য সম্পদ।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!