যেসব কারণে হালদায় এবার আশানুরূপ ডিম মেলেনি—হতাশ সংগ্রহকারীরা

এশিয়ার একমাত্র কার্প জাতীয় প্রাকৃতিক মৎস প্রজনন ক্ষেত্র হালদায় মধ্যরাতে ডিম আহরণ উৎসবের আমেজ দিনের আলোয় ফিকে হয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা ও পাহাড়ি ঢল না নামায় মা-মাছ এবার আশানুরূপ ডিম ছাড়েনি। ফলে হতাশ ডিম সংগ্রহকারীরা। এছাড়া হ্যাচারিতে পানি ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার সংকট নিয়েও ক্ষোভ জানান তারা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি কর্তৃপক্ষ তাদের জরিপের ভিত্তিতে জানিয়েছে, এ বছর ৬ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে অন্তত চারগুণ কম। তবে কি পরিমাণ ডিম সংগ্রহ হয়েছে তা সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয়নি।

জানা গেছে, এপ্রিল মাসের পর থেকে এ পূর্ণিমা পর্যন্ত তিনটি জো বা তিথি চলে গেলেও পর্যাপ্ত বৃষ্টি কিংবা আবহাওয়া শীতল না থাকায় এতদিন মাছ ডিম ছাড়েনি। তবে গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হওয়ায় ডিম আহরণকারীরা ডিম সংগ্রহে হালদায় নৌকা ভাসান।

বুধবার (২৬ মে) দিবাগত রাত একটার দিকে হালদার আজিমের ঘাটা, নাপিতের ঘোনা, স্লুইসগেট, মাছুয়া ঘোনা, নোয়াহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় মা-মাছ নমুনা ডিম ছাড়ে। বৃহস্পতিবার (২৭ মে) মধ্যরাতে মা-মাছ ডিম ছাড়ার পর ডিম আহরণকারীরা আশায় বুক বাঁধলেও রাতের আধারের সাথে সাথে ডিমের পরিমাণ কমে দিনের আলোয় সে আশা ফিকে হয়ে যায়। ডিমের পরিমাণ কমে যাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়ে আহরণকারীরা।

হালদায় মা মাছ ডিম ছাড়ার শর্ত হচ্ছে- পূর্ণিমা বা অমাবস্যার তিথি বা জো থাকতে হবে। একই সময়ে নদীর স্থানীয় এবং খাগড়াছড়ি, মানিকছড়িসহ নদীর উজানে পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে হবে। ফলে পাহাড়ি ঢল নামবে এবং নদীতে ফেনাসহ পানি প্রবাহিত হবে। ঠিক এ সময়ে পূর্ণ জোয়ার শেষে অথবা পূর্ণ ভাটা শেষে পানি যখন স্থির হয় তখনই কেবল মা-মাছ ডিম ছাড়ে। কিন্তু দেশে দূর্যোগের আশঙ্কা ও পাহাড়ি ঢল না থাকায় হালদায় ডিম ছাড়তে দেরি করে মা-মাছ।
তবে ডিম ছাড়লেও পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা ও পাহাড়ি ঢল না নামায় মা-মাছ আশানুরূপ ডিম ছাড়েনি। এতে হতাশ হয়ে পড়ে ১ হাজারের বেশি ডিম আহরণকারী।

ডিম আহরণকারীদের মতে, এই জো’তে মা-মাছ আশানুরূপ ডিম ছাড়েনি। আজকে (বৃহস্পতিবার) আর না ছাড়লে আগামী মাসের আমাবস্যা বা পূর্ণিমার জো’তে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল নামলে মা-মাছ পরিপূর্ণ ডিম ছাড়তে পারে।

এদিকে, সরেজমিনে হালদা পাড়ের উত্তর মাদার্শার শাহ মাদারি হ্যাচারীতে গিয়ে শুনতে হল ডিম আহরণকারীদের হতাশার গল্প। তাদের চোখেমুখে রাজ্যের চিন্তা।

বংশ পরম্পরায় ৫০ বছর ধরে ডিম আহরণকারী নুরুল আলম মেম্বার হতাশার সুরে জানান, মা-মাছ পুরো ডিম ছাড়েনি। ডিমের পরিমাণ বলছে এটি নমুনা ডিম। আসল ডিমের পরিমাণ এত কম নয়। বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে মা-মাছ আসল ডিম ছাড়বে। তবে এই সামান্য ডিম যা আহরণ করেছি তাও হ্যাচারি অব্যস্থাপনায় পানির অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। হালদা থেকে আমরা যে পাম্প মেশিনে পানি তুলি তা আমরা জনপ্রতি ১ হাজার টাকা করে মোট ৪৫ হাজার টাকায় হ্যাচারির খরচ বহন করলেও মৎস্য অধিদপ্তরের কাউকে আমরা পাশে পাইনি। যদিও হ্যাচারির ডিম আহরণের সময় পানি, বিদ্যুৎ ও অবকাটামোসহ সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার কথা ৷ অথচ আমরা রাতভর ডিম আহরণ করে নিজেরা আবার পাম্প মেশিনে ত্রুটি সারাতে দৌড়াদৌড়ি করেছি ৷ পরে আরো দুটি পাম্প মেশিন ভাড়ায় এনে দিনের ১২টায় কুয়ায় পানি সরবরাহ করি। ততক্ষণে অর্ধেকের বেশি ডিম নষ্ট হয়ে গেছে।

ডিম আরোহণকারীরা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমরা নিজেরা নিজেদের টাকায় হ্যাচারি ও পাম্প মেশিন চালিয়ে ডিম থেকে পোনা উৎপাদন করি। দিন শেষে মৎস্য অধিদপ্তরের স্যারেরা কেবল ডিম সংগ্রহের পরিমাণটা জেনে নেন। যদি মৎস্য অধিদপ্তর হ্যাচারি ব্যবস্থাপনায় সঠিক তদারকি করে তাহলে আমরা আরো বেশি পোনা উৎপাদন করে আর্থিকভাবে লাভবান ও দেশের মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন ভূমিকা রাখতে পারতাম।

জানা গেছে, ৫ এপ্রিল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে উপদেষ্টা, উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসারকে সভাপতি ও উপজেলা ভূমি কর্মকর্তাকে সদস্য করে মোট ৭ সদস্যর একটি হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা কমিটি করলেও হ্যাচারির কোন কাজে পাশে পায়নি বলে অভিযোগ করেন শাহ মাদরী হ্যাচারির ডিম আহরণকারীরা।

উত্তর মাদার্শার শাহ মাদরি হ্যাচারির ডিম আহরণকারী মো. ইলিয়াস, বশির আহমদ ও আরো কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হ্যাচারির মোট ৪৫টি কূপ মিলে সর্বমোট ৮০ বালতি ডিম আহরিত ডিম পোনা প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। যা গত বছরের তুলনায় অতি নগন্য। এছাড়া গড়দোয়ারা মাছুয়া গোনা হ্যাচারিতে ৭০ বালতি মদুনাঘাট বড়ুয়া পাড়া হ্যাচারিতে ৭৪ বালতি ডিম আহরণ করা হয়েছে বলে জানান ডিম সংগ্রহকারী মো. সেলিম।

নদী গবেষক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, পাহাড়ি ঢল না নামা, বৃষ্টি ও পানির স্রোত, মেঘের গর্জন, পানির তাপমাত্রা না থাকা, অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকা, খরতা ও অম্লতা সহনীয় পর্যায়ে না থাকা। পানিতে অতিরিক্ত লবনাক্ততা মা- মাছের ডিম কম ছাড়ার অন্যতম কারণ। এছাড়া মা- মাছ ডিম ছাড়ার সময় নদীর পাড়ে মানুষের কোলাহল না থাকা আবশ্যক। ইয়াস দূর্যোগের প্রভাব ও পানিতে লবনাক্ততা বেশি হওয়ার কারণে মা- মাছ ডিম কম ছেড়েছে। আগামী আমাবস্যা ও পূর্ণিমায় মা- মাছ ডিম ছাড়বে কিনা সন্দেহ রয়েছে। কারণ মা- মাছ এতদিন ধরে ডিম পেটে ধরে রাখাও সম্ভব নয়। ডিম ছাড়লেও তা পরিমাণ কম হতে পারে।

উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার মো. নাজমুল হুদা বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার ডিম সংগ্রহ অনেক কম। বৃষ্টি কম হওয়া, পাহাড়ি ঢল না নামা ও পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে মা- মাছ ডিম কম ছেড়েছে। আমরা হ্যাচারিগুলো নিয়মিত দেখাশোনা করছি। কোন হ্যাচারিতে কোন ধরনের সংকট ছিলনা। ডিম আহরণকারীদের অভিযোগ সত্য নয়।

এসএ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!