যেভাবে গড়ে উঠলো রেল পোষ্যদের নতুন প্লাটফর্ম

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের খালাসি পদে চাকরি করতেন আলী হোসেন (ছদ্মনাম)। এক বছর আগে অবসরে গেছেন তিনি। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ৫ সন্তান, স্ত্রী ও মাকে নিয়ে থাকেন চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী এলাকায়। পেনশনের টাকায় সংসারের এই ঘানি টানা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তাই ছোট একটি চায়ের দোকান দিলেন।

পেনশনের পাশাপাশি চা-বিস্কুট বিক্রির আয় দিয়েই ভাত-কাপড়ের যোগান দিয়ে যাচ্ছিলেন পরিবারে। কিন্তু করোনার থাবায় আলী হোসেনের সংসারের যোগানে ভাটা পড়েছে। সাধারণ ছুটিতে বন্ধ রাখতে হয় আয়-রোজগারের প্রধান অবলম্বন সেই দোকানটি। তার এখন নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা।

শুধু কি আলী হোসেন? রেল পরিবারের এমন কয়েকশ পরিবারের অবস্থা এমন। তাদের কেউ অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী, কেউ বা রেলওয়ের শ্রমিক। বেতনের টাকায় সন্তানসন্ততি নিয়ে চলতে না পেরে চাকরি সেরে কেউ কাজ করতো গ্যারেজে। কেউ বা দিয়েছে পান-সিগারেট কিংবা চায়ের দোকান। এসব বন্ধ থাকায় তাদের দুর্দশা বেড়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে রেলওয়ের এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছেন রেল পরিবারেরই এক সদস্য।

তিনি রাকিব উল্লাহ খান সোহেল। চাকরি করেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিজেল সপের পিটার-১ পদে। নিজের সঞ্চয়ের ৩০ হাজার টাকা দিয়ে রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট ৫০টি পরিবারের কাছে পৌঁছে দেন খাদ্যসামগ্রী। নিজেই খোঁজ নিয়ে এসব পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি।

এ বিষয়ে রাকিব উল্লাহ খান সোহেল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আত্মসম্মানের কারণে রেল পরিবারের অনেকেই দুর্দশার কথা মুখে বলতে পারছে না। আমি বিষয়টি উপলব্ধি করে চিন্তা করলাম তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। ঈদের আগেই তাই তাদের খোঁজ নিলাম। নিজের জমানো ৩০ হাজার টাকা দিয়ে চেষ্টা করলাম তাদের জন্য কিছু করতে। তারপর সন্ধ্যার নামলে তাদের ঘরে গিয়ে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছি। যাতে একজনের বিষয় আরেকজন জানতে না পারে সে জন্যই সন্ধ্যার পর নিজেই তাদের ঘরে ঘরে গিয়েছি।’

রেলওয়ের কয়েকজন শ্রমিক জানান, রাকিব উল্লাহ খান সোহেলের এই উদ্যোগের পর রেল পাড়ায় আলোচনা শুরু হয়। এরপর এগিয়ে আসেন আরও অনেকেই। অসহায় পরিবারগুলোকে সহযোগিতার লক্ষ্যে গঠন প্লাটফর্ম গড়ে তোলারও প্রস্তাব করে কয়েকজন। নাম দেওয়া হয় ‘রেল পোষ্য কল্যাণ পরিষদ’। সবাই মিলে এই সংগঠনের আহবায়কের দায়িত্ব দেয় রাকিব উল্লাহ খান সোহেলকেই।

পরবর্তীতে এই সংগঠনের উদ্যোগে রেলওয়েতে অসহায় শ্রমিক, অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের মধ্যে যারা আর্থিক কষ্টে রয়েছে এমন ২০০ পরিবারকে সহায়তা করা হয়।

সংগঠনটির পাশে দাঁড়ান চট্টগ্রাম নগরীর ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম। তিনি এ বিষয়ে বলেন, ‘ভাল ও সমাজের উন্নয়নমূলক কাজে আমি সহযোগিতা করি। রেলওয়ে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা করার এই প্লাটফর্মকে আমি সবসময় সহযোগিতা করে যাব।’

রেল পোষ্য কল্যাণ পরিষদের আহবায়ক রাকিব উল্লাহ খান সোহেল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘১৯৮৯ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে অধ্যাদেশ ১৩ সংশোধন করে রেলওয়ে শ্রমিক কল্যান ট্রাষ্ট গঠিত হয়। আমি নিজেই রেলওয়ে শ্রমিক কল্যান ট্রাস্টের নির্বাচিত পরিচালক। কিন্তু শ্রমিকদের কল্যাণে কাজ করার দারুণ সুযোগ থাকার পরও কেউ এগিয়ে আসেনি। স্বার্থের হিসেবনিকেশ আর লাল ফিতায় বন্দি থেকেছে সব। রেল শ্রমিক ও পোষ্যদের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে সবার সহযোগিতায় রেল পোষ্য কল্যাণ পরিষদ গঠন করা হয়েছে।’

রেলওয়ে পরিবারের সদস্য মাজহারুল ইসলাম রানা বলেন, ‘রেলশ্রমিক নেতারা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের নামে শুধু নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে। করোনার এই সময়েও তাদের কাছে পায়নি মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে রেলওয়ে পোষ্য শ্রমিক কল্যাণ পরিষদ শুরুতেই ২০০ পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’

জেএস/এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!