যমুনা অয়েলের এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গিয়াস উদ্দিন আনচারী। দীর্ঘদিন এই দায়িত্বে থাকায় যমুনা অয়েলের বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়েছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত হওয়ার আগেই সহসা ‘ম্যানেজ’ করে ফেলেন এই কর্মকর্তা। এমডি পদে একাধিক কর্মকর্তারা এক বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করতে না পারলেও গিয়াস উদ্দিন আনচারী সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে একটানা এই পদে দায়িত্ব পালন করছেন।

গিয়াস উদ্দিন আনচারী যমুনার বিভিন্ন অনিয়ম, তেল চুরি ও ডিপো থেকে মাসোহারা নিয়ে বানিয়েছেন অঢেল সম্পদ౼সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে উঠেছে এমন অভিযোগ। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) কমিশনে জমা হওয়া একটি অভিযোগে এসব তথ্য দেওয়া পাওয়া গেছে।

চলতি বছরের এপ্রিলের শুরুতে যমুনা অয়েলের কয়েকজন কর্মকর্তা দুদকে এই অভিযোগ জমা দেন।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড চট্টগ্রামের আওতায় সারাদেশে মোট ১৬টি ডিপোর কার্যক্রম রয়েছে। এসব ডিপো থেকে প্রতি মাসে তিনি মাসোহারা নেন প্রায় ৩০ লাখ টাকা। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এ টাকা বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিস এসএ পরিবহন চট্টগ্রামের কাজির দেউরি শাখার মাধ্যমে সংগ্রহ করেন তিনি। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় বর্তমানে গোপনে গ্রহণ করছেন এই টাকা।

আরও জানা যায়, যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ওয়ার্কার্স পার্টিসিপেশন ফান্ডের (ডব্লিউপিএফ) পরিমাণ প্রায় ২৮ কোটি টাকা। কোম্পানির তেল বিক্রি লাভের ৫ শতাংশ টাকা শ্রমিকদের মধ্যে বণ্টন করার নিয়ম রয়েছে। প্রতি বছর এ টাকা শ্রমিকদের মাঝে বণ্টন না করে নিয়ম বহির্ভূতভাবে এমডির নেতৃত্বে একটি গঠন করা একটি ট্রাস্টের নামে রাখা হয়। বিশেষ সুবিধা পেতে এমডির পছন্দের ব্যাংকগুলোতে এসব অর্থ জমা রাখা হয়। পরে কয়েক বছর ঘুরিয়ে এ টাকা দেওয়া হচ্ছে শ্রমিকদের।

যমুনা অয়েলে যেভাবে হচ্ছে ‘নিয়োগ বাণিজ্য’

অভিযোগ থেকে জানা যায়, যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ভেতরে জেনারেল পোস্ট অফিসের (জিপিও) শাখা রয়েছে। ওই শাখায় জমা হওয়া নিয়োগ পরীক্ষার আবেদনপত্রগুলো থেকে তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের আবেদনগুলো দেখে আলাদা করে রাখা হয়। সেখানে বাকি আবেদনগুলো থেকে কাজগপত্র সরিয়ে ফেলে আবেদন অসম্পূর্ণ বলে বাদ দেওয়া হয়। এতে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে যমুনা অয়েলের কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের নিয়োগ নিশ্চিত করা হয়।

গিয়াস উদ্দিন আনচারীর গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায়। সেখানে তিনি ছেলেমেয়ের নামে কিনেছেন জমি। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করছেন তার একমাত্র ছেলে। ছেলের নামে কেনা হয়েছে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাটও।

এদিকে প্রায় দুই বছর আগে দুদকের মামলায় অভিযুক্ত আহমেদ নুরকে যমুনার অয়েলের চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার একদিন আগে জিএম পদে পদোন্নতি দেয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। এক্ষেত্রে মোটা অংকের বড় লেনদেনের মাধ্যমে তাকে সহযোগিতার অভিযোগ উঠে যমুনা অয়েলের এমডি গিয়াস উদ্দিন আনচারীর বিরুদ্ধে। অথচ এ কর্মকর্তা যমুনা অয়েলে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন টাইপিস্ট পদে।

যমুনা অয়েলের সাবেক জিএম জসিমের বিরুদ্ধে ৬৫ হাজার টাকার তেল চুরির অভিযোগ বিপিসি’র তদন্তে প্রমাণিত হয়। তবুও তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে দেওয়া হয় পদোন্নতি। অভিযোগ রয়েছে, এ চুরির ঘটনায় মধ্যস্থতাকারী ছিলেন এমডি আনচারী।

দুই বছর আগে যমুনা অয়েলের কর্মকর্তা আমজাদ হোসেনের বদলি ছিল যমুনা অয়েলের চিলমারী ডিপোতে। সেখানে বাকিতে তেল বিক্রি করার দায়ে বিভাগীয় তদন্তে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। এ কর্মকর্তার কাছ থেকে এমডি আনচারী বিশেষ সুবিধা গ্রহণ করে বরখাস্তের পরিবর্তে উল্টো রাজশাহীতে ডিপোতে বদলি করে আমজাদকে।

জানা যায়, ২০০৭ সাল থেকে এক বছরের বেশি কোনো এমডি দায়িত্ব পালন করেনি যমুনা অয়েলে। কিন্তু গিয়াস উদ্দিন আনচারী ২০১৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে এখনও এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এদিকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এমডি গিয়াসের মেয়াদ পূর্তির আগে অয়েলের এফডিআর ভাঙানোর অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করে দুদক। ২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এ অভিযোগের বিষয়ে কোনো সত্যতা না পাওয়ায় যমুনা অয়েলের চার কর্মকর্তাকে দায়মুক্তি দেয় দুদক। অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকে এফডিআর জমা রাখা ও ভাঙার পেছনে মূল ভূমিকা ছিল যমুনা অয়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের। অথচ এফডিআর নিয়ে দুদকের তদন্তে এই কর্মকর্তার নাম নেই।

যমুনা অয়েলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, যমুনা অয়েল কোম্পানির সরকারি স্বায়ত্বশাসিত একটি প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিদিন তেল বেচাকেনার হিসাব থেকে শুরু করে অফিসের সমস্ত লেনদেনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হচ্ছে এমডির হাত ধরে। তার অর্ডার ছাড়া প্রতিষ্ঠানের কোনো নথিপত্র সংরক্ষণ করা, বিভিন্ন ডিপোতে তেল বেচাকেনার হিসাব সংরক্ষণ, বিল পাস, বিপিসি কেন্দ্রিক সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা ও ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই। তিনিই প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তা। তার মাধ্যমে সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে। অথচ দুদক তদন্তে তার নামে কোনো অভিযোগের সত্যতা পায় না।

জানতে চাইলে গিয়াস উদ্দিন আনচারী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ বলা হচ্ছে তা সঠিক না। আমাকে এই জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলতে কেউ হয়তো এসব অভিযোগ দিয়েছে। এমনকি দুদকেও আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।’

এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!