যন্ত্র দিয়ে মিথ্যা যাচাইয়ের দৌড়, কতোটা এগোল প্রযুক্তি?

মায়েদের সাথে মিথ্যে বলে শুরু হয় আমাদের মিথ্যে বলার জীবন। মিথ্যে বলতে আমাদের কেউ শিখিয়ে দেয় না। আমাদের মস্তিষ্কই আমাদের সংকেত দেয়। আমরা মিথ্যে বলতে শিখি শৈশব থেকেই। মস্তিস্কে মিথ্যে বলার কৌশল প্রতিদিনেই উন্নত হয়, পরিবর্তিত হয়। বিজ্ঞানীরা দাবি করেন মিথ্যে বলা শেখা মস্তিস্কের একটি পরিশীলিত সাফল্য।
ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার মনোবিজ্ঞানী জেরি জেলিসন তার গবেষণায় বলেন, প্রতিদিন একজন ব্যক্তি অন্তত ২০০ মিথ্যে শোনেন।

প্রাত্যহিক জীবনের নির্দোষ মিথ্যেগুলো সাদা ও ক্ষতিকারক নয়। ‘আপনার পোশাকটি সুন্দর’, ‘আপনি সুন্দর করে কথা বলেন’—পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় মানুষ এসব কথা কেবল অন্যকে খুশি করতেই বলে। অন্যদিকে হার্টফোর্ডশায়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড ওয়াইজম্যান বলেছেন, বেশিরভাগ মানুষ দিনে ১-২টি বড় মিথ্যা বলেন। নিজেদের প্রচার করতে, নিজেদের রক্ষা করতে এবং অন্যকে আঘাত করতে এই বড় মিথ্যেগুলো বলা হয়। এখান থেকেই অপরাধের শুরু।

মনোবিশারদরা বলেন, মিথ্যে বলার সময় দেহে কিছু পরিবর্তন ঘটে। বক্তার শরীরী ভাষা ওই অসত্যকে জানান দেয়। হৃদপিণ্ডের স্পন্দন বেড়ে যাওয়া, কপালে জমে আসা ঘামের ঘামের বিন্দু আরো কিছু সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি— যেমন মুখের ছোট ছোট পেশীগুলো সংকুচিত হয়, কেউ কেউ তোতলান, কথার মাঝে থেমে যান, মুখ ফসকে অন্য কথা বলে আগের বলা কথাকে সামাল দেন।

১৯০৫ সালে এক মনোবিজ্ঞানী লিখেছিলেন, ‘কোনও মরণশীল প্রাণির পক্ষে গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব না। যদি তার ঠোঁট চুপ থাকে তবে তবে তার আঙ্গুল কথা বলে। বিশ্বাসঘাতকতার চিহ্ন তার শরীরে সমস্ত ছিদ্র থেকে বেরিয়ে আসে।’

প্রায় ২০৬ জন বৈজ্ঞানিকের গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ ৫৪ শতাংশ সময়ে মিথ্যুককে ধরতে পারে।

পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী অ্যালার্ট ব্রিজ বলেছেন, যারা প্রতারণা শনাক্ত করার উপায় নিয়ে অনেক বছর অধ্যায়ন করেছেন তারাই বলছেন মিথ্যাবাদীরা বিশদ কথা বলেন বরং সত্যবাদীর কথা একঘেঁয়ে ও বিরক্তিকর মনে হয়।
অপ্রয়োজনীয় আলাপে বলা মিথ্যেগুলো নয়, দুশ্চিন্তার কারণ হলো যা কিছু অন্য পক্ষের ক্ষতি ডেকে আনে এমন মিথ্যে শনাক্ত করা। এর চেষ্টা চলেছে সহস্র বছর ধরে যা এখনো বিদ্যমান।

একটি মিথ্যে শনাক্ত করতে বিভিন্ন প্রকৃতির শারীরিক অত্যাচার করা হতো। এ নিয়ে দেশে দেশে অনেক মিথও ছিলো। মিথটা যে ভিত্তিতে বিচারকাজে ব্যবহার হত তা হলো সত্যবাদিকে স্রষ্টা রক্ষা করবেন। যেমন প্রাচীন ভারতে অগ্নিপরীক্ষা-কয়লার উপর হেঁটে যাওয়া, চীনে অভিযুক্তদের মুখে চাল দেয়ার পর কিছুক্ষণ পরে সেটা ফেলতে বলা হত, চাল ভেজা হলে সত্য, শুকনো হলে মিথ্যে- কারণ ওই সময়ে বিশ্বাস করা হত যে মিথ্যেবাদীর গলা শুকিয়ে যায়।

ইংরেজ লেখক ড্যানিয়েল ডিফো লিখেছিলেন, ‘অপরাধবোধ সর্বদা ভয় নিয়ে থাকে। চোরের রক্তে কাঁপুনি রয়েছে।’ কয়েক দশকের মধ্যে কম্পিউটিং শক্তি, মস্তিষ্ক-স্ক্যানিং প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থানে ধীরে ধীরে মিথ্যে শনাক্তে প্রযুক্তির ব্যবহারের প্রবণতা তৈরি হয়। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, সার্বভৌমত্ব রক্ষা, বিচার প্রক্রিয়ায় মিথ্যে শনাক্তকরণ প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী হয় রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো।

আলাবামা, অ্যারিজোনা, ক্যালিফোর্নিয়া, জর্জিয়া, ইন্ডিয়া, ক্যানসাস, নেভাডা, নিউ জার্সি, নিউ মেক্সিকো, নর্থ ডাকোটা, ওহিও, ইউটা, ওয়াশিংটন, ওয়াইমিং, ক্যালিফোর্নিয়া, অ্যারিজোনা, নেভাডা, জর্জিয়া এবং ফ্লোরিডায় মিথ্যে শনাক্তে পলিগ্রাফ মেশিনের ব্যবহার হয়।

মিথ্যা যাচাইয়ের পলিগ্রাফ প্রযুক্তি
মিথ্যা যাচাইয়ের পলিগ্রাফ প্রযুক্তি

পলিগ্রাফ প্রযুক্তি কিভাবে কাজ করে?
পলিগ্রাফ টেস্টে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক প্রতিক্রিয়া ধারণ করা হয় যার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয় যে একজন ব্যক্তি সত্য কথা বলছে কি-না। সাধারণত রক্তচাপ কেমন, শ্বাস-প্রশ্বাসের পরিবর্তন এবং হাতের তালু ঘামছে কি-না, নাড়ির গতি- এগুলোই তার মাপকাঠি হিসেবে কাজ করে। মিথ্যা বলার ফলে মানসিক চাপ বেড়ে যেতে পারে এবং মিথ্যা শনাক্তকরণ পরীক্ষার মাধ্যমে আচরণগত এবং মানসিক পরিবর্তনগুলো দেখা যায় যা মানসিক স্ট্রেস-এর সময় হয়ে থাকে। সুতরাং পলিগ্রাফ টেস্ট সরাসরি প্রতারণা এবং মিথ্যাকে পরিমাপ করে না, কিন্তু একজন ব্যক্তি কথা বলার সময় সাক্ষাতকার-গ্রহীতাকে প্রতারিত করছে কি-না তা দেখতে সক্ষম। এই তথ্য পরে অন্যান্য সবকিছুর সাথে ব্যবহার করা হয় এবং ওই ব্যক্তি সত্য বলছে কিনা সেটা নির্ণয় করা হয়।

মিথ্যা শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে পলিগ্রাফ প্রযুক্তি বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়। এই ডিভাইস দিয়ে রক্তচাপ, নাড়ির স্পন্দন, শ্বাসকষ্ট ও ত্বকের পরিবাহিতা যেমন শারীরবৃত্তীয় সূচক পরিমাপ করে ও রেকর্ড করে। যখন কোন ব্যক্তিকে প্রশ্ন করা হয় ও প্রশ্নকর্তাকে সে একাধিক প্রশ্নের উত্তরও দেয়— সেই সময় প্রতারণামূলক উত্তরগুলো একটি শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে যা প্রতারণাহীন সত্য উত্তরের সাথে মিলবে না।

১৯২২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল শিক্ষার্থী জন অগাস্টাস লারসন এবং ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে পুলিশ বিভাগের একজন কর্মকর্তা পলিগ্রাফ আবিষ্কার করেন।

মার্কিন আইন প্রয়োগকারী এবং ফেডারেল সরকারি সংস্থা যেমন এফবিআই, এনএসএ, সিআইএ এবং অনেক পুলিশ বিভাগ যেমন এলএপিডি এবং ভার্জিনিয়া রাজ্য পুলিশ সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে এবং নতুন কর্মীদের স্ক্রিন করার জন্য পলিগ্রাফ পরীক্ষা ব্যবহার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় ফেডারেল সরকারের মধ্যে একটি পলিগ্রাফ পরীক্ষাকে প্রতারণার সাইকোফিজিওলজিকাল শনাক্তকরণ (পিডিডি) পরীক্ষা হিসাবেও উল্লেখ করা হয়।

এছাড়াও পেনিল প্লেথিস্মোগ্রাফ যা একটি বিশেষ বন্ধনী। এর ব্যবহারে যৌন অপরাধীদের মধ্যে উত্তেজনার মাত্রা পরীক্ষা করে। ইনফ্রারেড ক্যামেরা ওই ব্যক্তির মুখের তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করে। এটি যৌন অপরাধীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। যদিও এটি ব্যবহার করা মানুষের জন্য অপমানের। অনেক দেশে এই পরীক্ষা বৈধতা হারিয়েছে।

মিথ্যা থেকে নির্ভরযোগ্যভাবে সত্যকে সাজিয়ে আনা, একটি মেশিন দিয়ে মানুষের আচরণের গভীর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা কি আদৌ সম্ভব ছিল? যদিও এই প্রযুক্তির নির্মাতারা যুক্তি দেখিয়েছেন, প্রতারণাকে শনাক্ত করে তারা একটি সুন্দর ও নিরাপদ বিশ্ব তৈরি করতে পারেন।

মিথ্যা-শনাক্তকরণ প্রযুক্তিতে বিভিন্ন ধরনের প্রমাণ পরীক্ষা করার প্রবণতা রয়েছে। প্রথম দুটি মৌখিক: আমরা যা বলি এবং যেভাবে আমরা তা বলি। কণ্ঠের চাপকে বিশ্লেষণ ও স্বর পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করে প্রতারণা সনাক্ত করা। জর্জ জিম্মারম্যানকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় এটি ব্যবহার করা হয়েছিল। তিনি ২০১২ সালে কিশোর ট্রেভন মার্টিনকে গুলি করেছিলেন এবং কাউন্সিলরা ২০০৭ ও ২০১০ সালের মধ্যে একটি স্কিম ব্যবহার করেছিলেন প্রতারককে ধরতে।

২০১৫ সালে একটি পরীক্ষায় ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখিয়েছেন তারা প্রতারণাকে শনাক্ত করতে সক্ষম—
পলিগ্রাফ রক্তচাপ, শ্বাস প্রশ্বাসের হার এবং ঘাম পরিমাপ করে।

নব্বইয়ের দশকে নতুন প্রযুক্তিগুলোর পঞ্চমটি উদ্ভাবিত হয়—এটি সম্ভবত তদন্তের আরও সহজ উপায় ‘মস্তিষ্ক’। নেটফ্লিক্স ডকুমেন্টারি মেকিংয়ে মরডিয়ার দ্বিতীয় পর্যায়ে স্টিভেন অ্যাভরি, যিনি নির্দয়ভাবে হত্যার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে যাচ্ছিলেন, তিনি দাবি করেছিলেন তিনি নির্দোষ। তাকে একটি ‘ব্রেইন ফিঙ্গারপ্রিন্টিং’ পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়েছিল, যা ইলেক্ট্রোডফ্ল্যাড্রাম নামে পরিচিত। একটি ইলেক্ট্রোড-স্টাডড হেডসেট ব্যবহার করে মানুষের স্নায়বিক ক্রিয়াকলাপ পড়তে পারে। ওই পরীক্ষার উদ্ভাবক ড. ল্যারি ফারওয়েল দাবি করেছেন, এটিতে অপরাধ সম্পর্কিত বাক্যাংশ বা ছবির স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। সন্দেহের বিষয়ে মস্তিষ্কে লুকোনো যে কোন অপরাধের তথ্য শনাক্ত করতে পারে।

২০০৮ সালে আরেকটি ইইজিভিত্তিক পরীক্ষা হয়েছিল। আর্সেনিক দিয়ে তার বাগদত্তা হত্যার অভিযোগে অদিতি শর্মা নামে ২৪ বছর বয়সী ভারতীয় মহিলাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিলো। তবে শর্মার শাস্তি আপিলের সময় উল্টে যায়। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এই পরীক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন।

২০০৬ সালে দুটি সংস্থা সিফস এবং নো লাই এমআরআই ক্রিয়ামূলক চৌম্বকীয় অনুরণন চিত্র বা এফএমআরআইয়ের ভিত্তিতে মিথ্যা শনাক্তকরণের প্রস্তাব দিয়েছিল। এ প্রযুক্তিতে শক্তিশালী চৌম্বক ব্যবহার করে সামাজিক সম্পর্কগুলো গণনা, স্মৃতিচারণ এবং স্মরণ নিয়ন্ত্রণের সাথে জড়িত মস্তিষ্কের যে অঞ্চলে রক্তের প্রবাহকে শনাক্ত করতে পারবে।

অবশ্য ৯/১১-এর পরে মার্কিন সরকার প্রতারণা শনাক্তকরণ বিজ্ঞানে অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে ওঠে। প্রতিরক্ষায় উন্নত গবেষণা প্রকল্প, মস্তিষ্ক-ভিত্তিক মিথ্যা-শনাক্তকরণে অর্থায়ন শুরু করে।

দেখা যাক মিথ্যে নির্ণয় কতটা প্রযুক্তিনির্ভর হতে পারে!

গার্ডিয়ান ও সাইকোলজি টুডে অবলম্বনে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!