‘ময়লা রাখুন পকেটে’— চসিক কাউন্সিলরের ভিডিওকাণ্ডের শিকার শিশুরা

‘ছিঃ! রাফি। ময়লা পকেটে রাখে না বাবা। প্লিজ বাবা ডাস্টবিনে ফেলো এসো। নইলে জীবাণু লেগে যাবে। এবার মা কিন্তু খুব বকবো’— এভাবেই ছয় বছরের ছোট্ট রাফির সাথে কথা বলছিলেন মা নুসরাত আনোয়ার লিপি। কাছে গিয়ে প্রশ্ন করতেই লিপি বললেন, ‘দেখেন না বাচ্চাটা কী যে শুরু করেছে। চোখের সামনে ময়লা দেখলেই সেটা তুলে পকেটে রাখছে। কী যে করবো বলেন? দেখেন দুই পকেট ভর্তি ময়লা। আসলে দোষ আমারই। কেন যে ওর সামনেই ভিডিওটা দেখলাম। এখন বাসায় বলেন আর বাইরে বলেন ময়লা দেখলেই পকেটে রেখে দেয়।’

কোন্ ভিডিও জিজ্ঞেস করতেই লিপি বলেন, ‘সেদিন ফেসবুকিং করতে করতে টাইমলাইনে আমাদের কাউন্সিলর শৈবাল দাদার একটা সচেতনতামূলক ভিডিও দেখেছিলাম। আর সেটাই আমার কাল হলো। বললেও বাচ্চাটা কথা শুনছে না।’

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ২১ নং ওয়ার্ড জামালখানের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের একটি ভিডিও বার্তা নিয়েই এতো কাণ্ড।

কী ছিল সেই ভিডিও বার্তায়
ফেসবুকে আপলোড করা ভিডিওবার্তার শুরুতেই দেখা যায়, রাস্তায় পড়ে থাকা চারটি টিস্যু এবং ঝালমুড়ির প্যাকেট এবং বিস্কুটের প্যাকেট দেখিয়ে একটি প্যাকেট কুড়িয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন কয়েক ভাঁজ করে পকেটে রাখছেন।

তারপর বললেন, ‘বন্ধুরা একটি ছোট্ট বিষয় আপনাদের মাঝে শেয়ার করার জন্য আমি আজ হাজির হয়েছি। যদিও ছোট কিন্তু এটির আবেদন এবং এটির বিশেষত্ব এবং এটি সমাজ সুন্দর করতে, পরিবর্তন করতে অনেক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করি। আমাদের এই চট্টগ্রাম শহরের প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের বসবাস। আমরা যখন আমাদের বেডরুম ড্রয়িং রুম কিংবা ডাইনিং রুমে, আমাদের একটি টিস্যু পেপার পড়ে কিংবা চকলেটের খোসা আইসক্রিমের খোসা কিংবা চিপসের খোসা পড়ে আমরা সেটি সযত্নে তুলে বিনে ( ডাস্টবিন) ফেলে দেই। অনেক সময় আমাদের ছেলেসন্তানকে বকাঝকাও করি। যাতে তারা ড্রইংরুম, বেডরুম কিংবা ডাইনিংটি অপরিষ্কার না করে। ঠিক একই জিনিস আমরা যখন ফুটপাতে আসি। রাস্তায় আসি। তার ব্যতিক্রম দেখা যায়। অর্থাৎ সেটি আমরা রাস্তায় কিংবা ফুটপাতে ফেলে দেই। এটি যদি আমরা ফুটপাত কিংবা রাস্তায় না ফেলে আমরা কিছুক্ষণের জন্য যদি সেটি আমরা আমাদের পকেটে রাখি এবং নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলি কিংবা বাসায় এসে যদি আমরা সেই টিস্যু কিংবা আইসক্রিমের খোসা কিংবা চকলেটের খোসা কিংবা চিপসের খোসাটি বিনে ফেলি। তাহলে আমাদের এই চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ বর্জ্য কমে যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এইভাবে আমাদের সমাজ পরিবর্তন হতে পারে। আসুন না, আমরা আগামীকাল থেকে এই শপথ নেই। আমরা কোন জিনিস বাইরে ফেলবো না। সেটা কিছুক্ষণের জন্য আমাদের পকেটে সংরক্ষণ করে নির্দিষ্ট দিনে ফেলবো।’

এ ভিডিও বার্তায় ইতিবাচক বার্তা থাকলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। ভিডিও বার্তার বক্তব্য বড়রা না মানলেও সরলমনে মেনে নিচ্ছে শিশুরা।

বাচ্চারা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে ময়লা পকেটে নেওয়ার ক্ষেত্রে কেমন প্রভাব পড়বে— এমন প্রশ্নে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সেলিম আকতার চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘হ্যাঁ এটা ক্ষতিকর তো। এটা স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্য বিরাট একটা হুমকি। এটা থেকে বিরত থাকার জন্য গার্ডিয়ানকে অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে। বাচ্চারা রাস্তাঘাটে হাঁটার সময় খেয়াল রাখতে হবে তারা যেন এটা মুখে না দেয়।’

তবে ভিন্নমত পোষণ করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ‘ভিডিও বার্তায় যে কথাগুলো ছিল তা গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেটা ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করার পরিবর্তে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করেছে। কারণ ভিডিও বার্তার শুরুতেই ময়লা পকেটে রাখার দৃশ্য দেখিয়েছে। অথচ এর কারণ ব্যাখ্যা করেছে ভিডিও বার্তার শেষে। এছাড়াও ময়লা ধরার পর হাত পরিষ্কার করার কোনো বক্তব্য ছিল না। যা একজন জনপ্রতিনিধির কাছে আশা করা যায় না।’

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. ইন্দ্রজিৎ কুণ্ড চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাচ্চারা অনুকরণপ্রিয়। কথা শোনার চেয়ে দেখার প্রতি তাদের আগ্রহ অনেক বেশি কাজ করে। এটাতো বাচ্চাদের কাছে ভুল বার্তা চলে গেল। দেখেন, আমাদের দেশে জনপ্রতিনিধি যারা হয় তাদের তো জনপ্রতিনিধি হওয়ার ট্রেনিং নেই। পৃথিবীর সব দেশে জনপ্রতিনিধি হওয়ার আগে-পরে ট্রেনিং থাকে। এখানে ট্রেনিং তো নাই কারো।’

বাচ্চাদের ময়লা কুড়িয়ে পকেটে রাখলে কী ধরনের সংক্রমণ হতে পারে— এ প্রসঙ্গে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার প্রণব কুমার চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটাতে তো অবশ্যই স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। ওই ময়লার মধ্যে কুকুর বা বিড়ালের অনেকগুলো জীবাণু থাকতে পারে। সেগুলো বাচ্চাদের শরীরে প্রবেশ করে কৃমি সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। আর সেখানে তো নানারকম জীবাণু সংক্রমণ তো ঘটেই। বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের মাধ্যমে নানান রকম রোগ হতে পারে।’

তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও বার্তার বিষয় প্রসঙ্গে কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ ময়লা তুলে পকেটে রাখছি না। আমি দেখালাম যে ময়লাটা ওখানে না ফেলার জন্য। মানে না ফেলে আমরা যদি ওইটা ধরেন, চিপস খেলাম কিংবা চকলেট খেলাম। চিপস খেয়ে চিপসের খোসা ওখানে না ফেলে পকেটে রেখে দেই, চকলেটের খোসাটা পকেটে রেখে দেই। চট্টগ্রাম শহর বলেন আর ঢাকা শহর বলেন বিভিন্ন শহরে ভাতের মাড় কিংবা অন্যান্য বর্জ্য এভাবে ফেলে না। আমাদের শহরটা নোংরা হচ্ছে। কিন্তু ওই ডেইলি আমরা যেগুলো খাচ্ছি বাদাম, চকলেট, আইসক্রিম, চিপস ওইগুলো পড়ে নোংরা লাগে এবং ওইটা প্রচুর হয়। ওইটা যদি আমরা না ফেলে অন্তত পকেটে রাখি এবং নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বিন আছে, বিনে ফেলি। আমার একদম সম্পূর্ণ বক্তব্য আছে।’

তবে ভিডিও বার্তায় গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য থাকলেও তার সঠিকভাবে উপস্থাপন হয়নি বলে শিক্ষাবিদ সাবেক অধ্যক্ষ ডা. আনোয়ারা আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘একজন নাগরিকের ভাবনায় যদি আনি সেটা হচ্ছে, উনি যেটি পকেটে রাখলেন এটার একটা মেসেজ আছে। সেটা হচ্ছে আমি ময়লাগুলো রাস্তায় না ফেলে, পকেটে হলে রেখে রাস্তাটা নোংরা না করি। আমি পকেটে রাখলাম এবং নির্দিষ্ট জায়গায় ডাস্টবিনে ফেলবো। এটাই বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু এইভাবে দিলে এটার যে বার্তাটা দিচ্ছেন সেই বার্তাটা এখন বুমেরাং হয়ে যাবে। সেটা শিশুরা বা কিশোররা যারা না বুঝে ফলো করতে গিয়ে পকেটে রেখে দেবে। আমি যেটাই পোস্ট দেবো আমি একটু আমার ভেতরে সচেতনতা থাকতে হবে।’

এসআর/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!