‘ম্যানেজ’/ হত্যামামলার আসামিকে বিকেলে ধরে রাতে ছেড়ে দিল রাঙ্গুনিয়া পুলিশ!

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার কৃষকলীগ নেতা ও দক্ষিণ রাজানগরের ইউপি সদস্য আবদুল আজিজকে আটক করার পাঁচ ঘন্টা পর ছেড়ে দিয়েছে রাঙ্গুনিয়া থানা পুলিশ। অর্ধডজন মামলার এই আসামির মাথার ওপর ঝুলছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। তার বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যামামলা, হত্যাচেষ্টা মামলাসহ চাঞ্চল্যকর কয়েকটি মামলা। অন্তত চারটি মামলার চার্জশিট ও ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি তিনি।

রুবি আকতার নামে এক মহিলার লিখিত অভিযোগে শনিবার (৮ জুন) বিকেলে দক্ষিণ রাজানগর ধামাইরহাট থেকে রাঙ্গুনিয়া থানার এসআই শরীফের নেতৃত্বে একদল পুলিশ আজিজকে আটক করে। তবে তাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় সন্ধ্যায়। এরপর তাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিতে তৎপর হয়ে উঠে এক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। আটক আব্দুল আজিজ দক্ষিণ রাজানগর ৪নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য এবং রাঙ্গুনিয়ার দক্ষিণ রাজানগর কৃষকলীগের সভাপতি বলে জানা গেছে।

যতো মামলা আজিজের বিরুদ্ধে

abdul-aziz-rangunia
সেই আবদুল আজিজ
আব্দুল আজিজের নাম শুনলেই আঁতকে উঠে দক্ষিণ রাজানগরের লোকজন। থানায় মামলা তো দূরের কথা, ভয়ে অনেকে তার নামও উচ্চারণ করে না। খুন, অপহরণ, ডাকাতি, নারী নির্যাতন, জায়গা দখল, বনদখলসহ নানান অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রয়েছে অন্তত ছয়টি মামলা। মামলাগুলো হচ্ছে যুবলীগ নেতা মাহবুব হত্যামামলা (মামলা নং ২১ (১১) ২০১৪)। সিআইডি এ মামলার চার্জশিট দিয়েছে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ। আমিন অপহরণ ও হত্যা চেষ্টা (মামলা নং ১৪ (৯) ২০১৪)। সিআইডি মামলাটির চার্জশিট দিয়েছে চলতি বছরের ২০ মার্চ। এছাড়াও পরিবেশ আদালতে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে (নম্বর ১১/২০১৮)। রাঙ্গুনিয়ায় অবৈধভাবে পাহাড়কাটার সময় পাহাড়ধসে শিশুসহ তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় বনবিভাগের মামলায় তাকে প্রধান আসামি (মামলা নম্বর ৫/২০১৮) করা হয়। রাঙ্গুনিয়া এক ইউপি মহিলা সদস্য তার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে আরেকটি মামলা দায়ের করেন (নম্বর ৮৮৮/২০১৪)। রাঙ্গুনিয়ার আলোচিত কাশেম ডাক্তার ঘর ডাকাতি মামলার এজাহারভূক্ত আসামি হিসেবেও নাম রয়েছে আজিজের।

যেসব মামলায় চার্জশিট ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
আজিজের বিরুদ্ধে চারটি মামলায় এরই মধ্যে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। মামলাগুলো হচ্ছে যুবলীগ নেতা মাহবুব হত্যা মামলা, আমিন অপহরণ ও হত্যা চেষ্টা মামলা, পরিবেশ আদালতের মামলা নম্বর এবং রাঙ্গুনিয়ায় মাটিচাপায় তিন শিশুর মৃত্যু মামলা। এসব মামলায় আজিজের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকলেও পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে তিনি চলেন সদর্পে।

আটকের ঘটনা যেভাবে ঘটলো
দক্ষিণ রাজানগরের ধামাইরহাট এলাকার রুবি আকতারের অভিযোগ, আব্দুল আজিজ অস্ত্রসহ দলবল নিয়ে তার বাড়িতে দুই দফা হামলা চালায়। নিরুপায় হয়ে রুবি আকতার রাঙ্গুনিয়া থানায় আজিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগ পেয়ে এসআই শরীফের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ৮ জুন বিকেলে রাঙ্গুনিয়ার দক্ষিণ রাজানগর মোহাম্মদপুর গলাচিপা এলাকার হত্যামামলাসহ একাধিক মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামি ও শীর্ষ সন্ত্রাসী মোহাম্মদ আজিজ মেম্বারকে আটক করে।

বিকেলে ‘আসামি’, সন্ধ্যায় জামাই আদর
শনিবার (৮ জুন) দক্ষিন রাজানগর ধামাইর হাট থেকে বিকেলে রাঙ্গুনিয়া থানার এসআই শরীফের নেতৃত্বে পুলিশ হত্যামামলার আসামি আজিজকে আটক করে সন্ধ্যায় থানায় নিয়ে যায়। শুরুতে পুলিশ সাধারণ আসামির মতোই তার সঙ্গে আচরণ করলেও রাত গড়াতেই আচরণ পাল্টে যায় পুলিশের। চা থেকে শুরু করে আপ্যায়নের সব ধরনের ব্যবস্থাই করা হয় এ সময়। হত্যামামলার আসামি আজিজ এ সময় কখনও এসআই শরীফের কক্ষ, কখনও ওসি তদন্ত আবার কখনও থানার ওসির কক্ষে মেতে উঠেন খোশগল্পে। রাত ১১টা ১৫ মিনিটে তাকে সসম্মানে ছেড়ে দেওয়া হয়।

উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানের দৌড়ঝাঁপ
জানা যায়, আজিজকে আটকের পর তাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিতে তৎপর হয়ে উঠেন রাঙ্গুনিয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলামসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। তারা আজিজ যে অভিযোগে আটক হন, ওই মামলার বাদির দেবর যুবলীগ নেতা মো. আবুল কাশেমের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

এ বিষয়ে দক্ষিণ রাজানগর যুবলীগের সদস্য মো. আবুল কাশেম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আজিজকে আটকের পর রাঙ্গুনিয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগের নেতার চাপ প্রয়োগে আমি ভাবীকে আপোষ করে ফেলার কথা বলি। তারা নগরীর একটি কনভেনশন হলে তথ্যমন্ত্রীর পারিবারিক একটি অনুষ্ঠান থেকে আমাকে রাঙ্গুনিয়া থানায় নিয়ে আসেন। পরে থানার ওসির রুমে বসে দুটি সাদা কাগজে আজিজ এবং আমাদের স্বাক্ষর নিয়ে বিষয়টি আগামী শুক্রবার ধামাইরহাটে সালিশি বৈঠকে সমাধান করবে বলে জানায়। এরপর আজিজকে রাত ১১টায় ছেড়ে দেয়।’

অন্যদিকে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, ভুল ইনফরমেশনে পুলিশ আজিজকে আটক করে। পরে অভিযোগকারীর সঙ্গে আপোষে আজিজকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
চারটি মামলায় গ্রেপ্তারিপরোয়ানা যার মাথায়, সেই আসামির পক্ষে কেন তদবির জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত কন্ঠে বলেন, ‘কে কোন্ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আসামি এটা জানা আমার কাজ নয়।’
ফোনালাপের একপর্যায়ে শফিকুল ইসলাম আপোষে আব্দুল আজিজের ছাড়া পাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে হুমকির স্বরে এ প্রতিবেদকের নাম জানতেও চান।

পুলিশের বক্তব্যে রহস্যের আভাস
আব্দুল আজিজকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে রাঙ্গুনিয়া থানার এসআই শরীফ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ওসি সাহেবের নির্দেশে তাকে থানায় ডেকে আনা হয়। পরে অভিযোগকারীর সঙ্গে আপোষে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। চার্জশিট ও ওয়ারেন্টের আসামি কিভাবে থানা থেকে ছাড়া পায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব আমার জানা নেই। ওসি জানেন।’

রাঙ্গুনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইমতিয়াজ ভূইয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আব্দুল আজিজ নামে কাউকে আটক করে থানায় আনা হয়নি, ছেড়ে দেওয়াও হয়নি।’

এসআই, আসামি এবং অভিযোগকারীর বক্তব্যে সত্যতা পাওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাকে এসপির মতো জেরা করবেন না। যা বলছি তাই লেখেন। পরে ফোন করে তিনিও এ প্রতিবেদকের নাম জানতে চান।’

আটক হইনি, তবে থানায় ছিলাম
এ বিষয়ে অভিযুক্ত আবদুল আজিজ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাকে পুলিশ আটক করেনি। পুলিশ আমাকে থানায় যেতে বললে, আমি থানায় গিয়েছি। যে বিষয়ে ডেকেছিল, বিষয়টি আপোষ-মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত আমি থানায় ছিলাম। পরে বিষয়টি মীমাংসা হলে আমি থানা থেকে চলে বাসায় চলে যাই।’

তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে মনে হয়।

এদিকে পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি অবগত নই। বিষয়টি ওসির সঙ্গে আলাপ করে আপনাকে জানাতে হবে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!