মোহনের কব্জায় অস্ত্র মাদকের রমরমা ব্যবসা, এক হাতেই সাবাড় ৪০ পাহাড়

ভগ্নিপতি নেতার শক্তিতে শ্যালক বলীয়ান

সদ্য শেষ হওয়া বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলার পর রাত ১টার দিকে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রানীরহাট এলাকায় পূবালী ব্যাংকের সামনে উল্লাস করছিলেন স্থানীয় স্কুল-কলেজের ছাত্ররা। হঠাৎ একটি গাড়ি এসে তাদের কয়েকজনকে ধাক্কা দিয়ে সামনের দিকে চলে যায়। পরে তারা কয়েকটি বাইকে ওই গাড়িকে ধাওয়া করে পথ আটকায়। সেই গাড়ি থেকে নেমে আসে ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মহিউদ্দীন তালুকদার মোহনসহ আরও কয়েকজন। মোহন এরপর একটি নাইন এমএম পিস্তল উচিয়ে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে। এর একপর্যায়ে ছাত্রদের হুমকি দিয়ে সরে যেতে বাধ্য করে।

নিজে ইউপি সদস্য হলেও মোহনের মূল শক্তি তার ভগ্নিপতি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম তালুকদার এবং ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন চৌধুরী।
নিজে ইউপি সদস্য হলেও মোহনের মূল শক্তি তার ভগ্নিপতি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম তালুকদার এবং ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন চৌধুরী।

এমন দাপুটে যে মোহন, তিনি সাধারণ এক ইউপি সদস্য। অন্তত ৫০ জনের একটি বাহিনী আছে তার। সেই বাহিনীর কব্জায় রয়েছে নিত্যনতুন অস্ত্রের ভাণ্ডার। তবে মোহন নিজে যে কালো নোহা মাইক্রোবাসে এলাকা দাপিয়ে বেড়ান, সেখানে সবসময়ই তার সঙ্গে থাকে ৫ থেকে ৭ জনের একটি দল। স্থানীয়দের তথ্যমতে, সেই গাড়িতে একটি পিস্তল, দুটি এক নলা বন্দুক ও একটি এক দুই নলা বন্দুক মজুত থাকে।

মোহনের কব্জায় অস্ত্র মাদকের রমরমা ব্যবসা, এক হাতেই সাবাড় ৪০ পাহাড় 1

এভাবে অবৈধ ইটভাটার বাণিজ্য, এলাকাভিত্তিক মাদকব্যবসা, চাঁদাবাজি, বনবিভাগের গাছ কাটা, পাহাড় কাটা মাটি বেচাকেনাসহ বিচিত্র সব অপকর্মে জড়িত মহিউদ্দীন তালুকদার মোহন। ছয় বছর ধরে ইউপি সদস্য থাকার সুবাদে রীতিমতো অপকর্মের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন তিনি।

এলাকাজুড়ে মোহন-আতঙ্ক

পুলিশ ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোহনের বাহিনী মূলত চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নে এমন ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে অপকর্ম চালায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটির জেলার সীমান্তবর্তী এই এলাকার সব ধরনের অপকর্মের নিয়ন্ত্রক মোহন। মাদকসেবী এই ব্যক্তি একাধিকবার মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে থাকার পরও বনে গেছেন জনপ্রতিনিধি। নিজে ইউপি সদস্য হলেও তার মূল শক্তি তার ভগ্নিপতি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম তালুকদার এবং ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন চৌধুরী। অভিযোগ আছে, তাদের প্রত্যক্ষ মদদে সব অপকর্ম করছেন মোহন।

রাঙ্গুনিয়া মডেল থানা পুলিশ বলছে, এলাকার লোকজন মোহন বাহিনীর কাছে এক ধরনের জিম্মি। কিন্তু তার ভয়ে কেউ অভিযোগ জানানো তো দূরের, কথা বলারই সাহস পায় না। রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বর্তমান ও সাবেক একাধিক জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, সাংবাদিক এবং স্থানীয় বাসিন্দাসহ অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা বললে তাদের প্রত্যেকেই অভিন্ন অভিযোগ করেন।

অপরাধ একের পর এক

মহিউদ্দীন তালুকদার মোহনের অপকর্মের তালিকায় আছে ধর্ষণ ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের অভিযোগও। অভিযোগ রয়েছে, ধর্ষণ মামলার আসামি মোহন এলাকার এক নারীকে ধর্ষণের পর ভিডিও ধারণ করেন। পরে ওই নারীর বাবা আদালতে ধর্ষণ মামলা করলে উল্টো তাকে এবং তার আরেক জামাতাকে দুটি মামলায় ফাসিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছিল। একপর্যায়ে ধর্ষণ মামলাটি তুলে নিতেও তাদের বাধ্য করা হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী নারীর ভগ্নিপতি।

সর্বশেষ গত রোববার (২৫ ডিসেম্বর) অবৈধ ইট ভাটার সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাংবাদিক আবু আজাদকে অস্ত্র ঠেকিয়ে, অপহরণ করে দফায় দফায় মারধর করেন মোহন ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজ উদ্দিন চৌধুরী ও ইউপি সদস্য মোহনসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী সাংবাদিক। এই মামলার প্রাথমিক তদন্তে রাঙ্গুনিয়া মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) খাঁন নূরুল ইসলাম উল্লেখ করেন, ‘আসামিরা উচ্ছৃঙ্খল প্রকৃতির। তারা প্রায় সময় জনগণকে অপমান-অপদস্ত করে আসছে। তাদের আচরণে এলাকাবাসী অতিষ্ট। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে প্রকাশ্যে আক্রমণের শিকার হয়। এলাকার মানুষ তাদের কাছে জিম্মি।’

ভগ্নিপতি নেতার শক্তিতে শ্যালক বলীয়ান

উপজেলা আওয়ামী লীগের পদধারী এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মহিউদ্দীন তালুকদার মোহনের ভগ্নিপতি শামসুল আলম তালুকদার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং রাজানগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। চট্টগ্রাম জেলা জাতীয়তাবাদী যুবদলের সহসভাপতি ইউসুফ চৌধুরীর সঙ্গেও তার ইট ভাটার ব্যবসা রয়েছে। এ সুবাদে তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকও।

উপজেলার রাজনীতিতে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে একমাত্র শ্যালক মোহনকেও রাজনীতিতে আনেন শামসুল আলম। মোহনের পৈত্রিক বাড়িও রাজানগরে। তিনি সেখানকার ভোটার ছিলেন। শুধু নির্বাচনে দাঁড় করাতে মোহনের নির্বাচনী এলাকা ইসলামপুরে স্থানান্তর করা হয়। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ইসলামপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হিসেবে কাউকে দাঁড়াতে না দিয়ে মোহনকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করা হয়। এখান থেকে শুরু মোহনের উত্থান। বর্তমানে তিনি উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের উপ-ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক। ২০২১ সালের নির্বাচনে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে ইউপি সদস্য হন।

এ ব্যাপারে মোহনের ভগ্নিপতি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলম তালুকদার বলেন, ‘তার (মোহন) বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার সঙ্গে তেমন সম্পর্ক নেই। তবে অভিযোগগুলো সত্য নয়। ইসলামপুরের জমিদার ছিল মোহনের পরিবার। এ কারণে সে নির্বাচনী এলাকা স্থানান্তর করেছে। ভোটাররা তাদের জায়গায় থাকে। এ কারণে তারা তাকে নির্বাচিত করেছে।’

মাদকসম্রাটের সঙ্গে থেকে মাদকসেবী

ইসলামপুর ইউনিয়নের একজন ইউপি সদস্য বলেন, একসময় রাঙ্গুনিয়ার মাদকসম্রাট ঝলকের সহযোগী ছিলেন মোহন। তার সঙ্গে থেকেই নিজেও মাদকাসক্ত হন। ২০১৮ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযানের সময় ঝলকের আস্তানা ভেঙে দেওয়া হয়। ওই সময় মোহনও পলাতক ছিলেন দীর্ঘদিন। ২০১৯ সালের দিকে নিজে আবার মাদক ব্যবসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাহিনী গড়ে তোলেন। মূলত সেখানে ফেনসিডিল ও ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। একাধিকবার মাদক নিরাময় কেন্দ্রেও ছিলেন মোহন।

মহিউদ্দীন তালুকদার মোহনের ইয়াবা সেবনের কিছু ছবি কাছে এসেছে। এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে চাইলে গত রোববার (২৫ ডিসেম্বর) তিনি বলেন, ‘আমি আগে মাদক সেবন করতাম। তিনবার মাদক নিরাময় কেন্দ্রেও ছিলাম। এখন ভালো হয়ে গেছি। আমি দুবার পরিবার নিয়ে হজে গিয়েছি। বাকি অভিযোগগুলো মিথ্যা।’

এক মোহনের হাতেই ৪০ পাহাড় সাবাড়

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, মোহনের দাদা রহম আলী তালুকদার মসজিদ-মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য ওয়াকফ এস্টেট গঠন করেছিলেন। এই ওয়াকফ এস্টেটের অধীনে থাকা প্রায় ৩০ একর জায়গা ইট ভাটার জন্য ভাড়া দেন মোহন। সেখান থেকে নামমাত্র টাকা মসজিদ-মাদ্রাসায় দিয়ে বাকিটা নিজেই ভোগ করেন তিনি। ওয়াকফের এসব জমি থেকে বছরে দেড় কোটি টাকার বেশি আয় হয়। ওয়াকফের জায়গার আশপাশের বন বিভাগের সরকারি জায়গা দখল করে স্থানীয়দের কাছে দখল হিসেবে ভাড়া দেন।

তিনি জানান, ইসলামপুর ইউনিয়নে ৭০টির বেশি ইট ভাটা রয়েছে। এসব ইট ভাটার জন্য টপ সয়েল সরবরাহ করেন মোহন। মূলত বনবিভাগের পাহাড় থেকে মাটি কেটে নিয়মিত বিক্রি করেন। এ পর্যন্ত ৩০-৪০টি পাহাড় কেটেছেন মোহন। গত পাঁচ বছরে অন্তত ২০ কোটি টাকার মাটি বিক্রি করেছেন মোহন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ভগ্নিপতি শামসুল আলমসহ তার পুরো পরিবার প্রভাবশালী হওয়ায় মোহনের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারেন না। ইটভাটার শ্রমিকদের মাধ্যমে মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।

অফিসের নামে টর্চার সেল

রাঙ্গুনিয়ার ইসলামপুর ইউনিয়নের মঘাছড়ি এলাকাটি রাঙামাটির একেবারে সীমান্তবর্তী। এই বাজারে মোহনের একটি কার্যালয় আছে। আগে এটি ইটভাটার কার্যালয় ছিল। মোহন ইউপি সদস্য হলেও তিনি পরিষদে অফিস করেন না। তার এই কার্যালয়েই ‘শালিস-বিচার’ করেন। এটিকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জসহ কর্মকর্তারাও সেখানে নিয়মিত বসেন। আর টর্চার সেলের শালিসে মানুষকে নির্যাতন, চাঁদা আদায়ের জন্য অপহরণ করে রাখা হয় বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেন। সীমান্তবর্তী এলাকায় হওয়ার কারণে পাহাড়ের সন্ত্রাসীদের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছেন মোহন।

মোহনবাহিনীর অবৈধ অস্ত্র নিয়ে ভাবছে প্রশাসন

রাঙ্গুনিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহবুব মিলকী বলেন, “মঘাছড়ি এলাকাটি দুর্গম। থানা থেকে অনেক দূরে। কেউ আমাদের অভিযোগ করেনি এতোদিন। আমরা এখন বিভিন্ন দিক থেকে শুনছি। অবৈধ অস্ত্র প্রকাশ্যে বাজারে উঁচিয়ে ধরার বিষয়টিও স্থানীয় জনগণ আমাদের জানিয়েছেন। অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে।’

চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে পুলিশ। অভিযুক্ত মোহনের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!