মেয়েদের রোগে লম্বা সিরিয়াল চট্টগ্রাম মেডিকেলে, অপারেশনে গিয়ে হচ্ছে নতুন রোগ

চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্ত্রীরোগের চিকিৎসা নিতে গিয়ে নারীদের পড়তে হচ্ছে দীর্ঘ সিরিয়ালে। দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে অপারেশনের টেবিলে গিয়ে শিকার হচ্ছেন নতুন রোগের। ফিস্টুলা, প্রল্যাপ্স, জরায়ুর মুখের ক্যান্সার, মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত, ইকটোপিক প্রেগনেন্সি, ফ্রাইব্রয়েড টিউমারসহ ভয়ঙ্কর সব রোগে আক্রান্ত হয়ে শুধুমাত্র অপারেশনের দেরি হওয়ায় আর সঠিক চিকিৎসাই হচ্ছে না। স্ত্রীরোগীরা পড়ছেন নতুন সমস্যায়। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও ভুক্তভুগীদের কাছ থেকে জানা গেছে এর সত্যতা।

চট্টগ্রামের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ শাহানারা বেগম চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামে নারীদের স্ত্রীরোগের ইতিহাসের প্রেক্ষাপট অন্যসব জেলা থেকে একটু ভিন্ন। অজ্ঞতা, কুসংস্কারের কারণে চট্টগ্রামের বেশিরভাগ নারী প্রজনন স্বাস্থ্য ও স্ত্রীরোগকে নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছেন। কম বয়সে বিয়ে, অধিক সন্তান নেওয়া, গর্ভোত্তর সেবার অভাব, বিলম্ব ও বাধাগ্রস্থ প্রসব, প্রশিক্ষণ পাওয়া সেবাদানে অনুপস্থিতি, দারিদ্র্য ও কুসংস্কার ছাড়াও সচেতনতার অভাবে চট্টগ্রামের নারীরা চিকিৎসা নিতে গিয়ে নতুন করে অন্য রোগে পড়ছেন। শুধুমাত্র অপারেশনের বিলম্ব হওয়ায় অপারেশন পরবর্তী উচ্চ রক্তচাপ, রক্তশূন্যতাসহ অনান্য জটিলতায় অপারেশন সফল হচ্ছে না।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগ ৩১ নং ওয়ার্ডে প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতার কারণে প্রায় প্রতিদিনই অসংখ্য রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। এখানে শয্যা আছে ৬৪টি। কিন্তু প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৩০ জন রোগী ভর্তি থাকে এ ওয়ার্ডে। এ ওয়ার্ডে চিকিৎসার প্রধান ধাপ অপারেশন হলেও চিকিৎসক সংকটে তাতে বিলম্ব হচ্ছে। এছাড়াও বিশেষ সুবিধা কিংবা ডাক্তারদের সঙ্গে সখ্যতার কারণে কোনো কোনো রোগী পরে ভর্তি হয়েও আগে অপারেশনের সুযোগ পাওয়ায় পিছিয়ে পড়া খারাপ রোগীদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। এর ওপর রয়েছে ৩১ নং ওয়ার্ডের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যসেবা উপকরণের বেহাল দশা। রোগীরা কোন ওষুধই পান না হাসপাতাল থেকে।

ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, গত তিন মাসে যেসব অপারেশন হয়েছে সেসব রোগীদের অনেকেই এখনও এ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন। ওই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন বোয়ালখালীর রোমেলা হাসান বলেন, তার প্রল্যাস্পেরই অপারেশন ডাক্তাররা করিয়েছেন দুইবার। তারপরও তার সমস্যা সমাধান হয়নি।

এদিকে এ ওয়ার্ডের রোগীদের মুখে মুখে রয়েছে প্রতিদিনের নানা দুর্ভোগের কথা ও রোগের শুরুর গল্প। গত রোজার আগে পঞ্চম সন্তানটি বাড়িতে ডেলিভারির চেষ্টা করাতে গিয়ে প্রস্রাবের থলি ফেটে যায় রাউজানের লতিফার। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেলে এনে সিজার করালেও তার শেষ রক্ষা হয়নি। ফিস্টুলা অপারেশনের জন্য তাকে এ ওয়ার্ডে ভর্তি করালে ভর্তি হওয়ার আটদিন পেরিয়ে গেলেও তার অপারেশন হয়নি। এখন তার প্রস্রাব ঝরছে অনবরত।

কিন্তু বিশেষজ্ঞ সূত্রে জানা গেছে, এ দীর্ঘ সময় পরে জরায়ুর সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের অপরেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়া ঝুকিপূর্ণ। তাই এ রোগের অপারেশন যত শীঘ্রই সম্ভব করা উচিত বলে মনে করেন তারা।

৩১ নং ওয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে, এ ওয়ার্ডে অপারেশনের জন্য চলতি সপ্তাহে রোগীর সিরিয়াল রয়েছে ৪৫ জনের। কিন্তু ৪৫ জনের মধ্যে ১০ জনেরও অপারেশন সম্পন্ন হবে না বলে জানিয়েছেন এ ওয়ার্ডের নাম প্রকাশে কয়েকজন ইনডোর মেডিকেল অফিসার। কারণ হিসেবে তারা অপারেশন থিয়েটার ও ডাক্তার স্বল্পতাকেই দায়ী করেছেন। করোনার এই সময়ে প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসকরা কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত নন। হাসপাতালে আসলেও কিছুক্ষণ পরে চলে যান।

এদিকে অপারেশনের জন্য দীর্ঘ সিরিয়ালে থাকা রোগীরা দুর্বিসহ দিন কাটাচ্ছেন। গরিব রোগীদের দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকতে গিয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে হচ্ছে।

ওয়ার্ড ঘুরে আরও দেখা গেছে ইকটোপিক প্রেগনেন্সির রোগীরা অপারেশনের অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, এ অপারেশন বিলম্ব হওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ জরায়ুর টিউবে ইকটোপিক প্রেগনেন্সিতে শিশু জন্ম নেয় ডিঅ্যান্ডসি পূর্ববর্তী এমআর ও ডিঅ্যান্ডসি সংক্রমণের কারণে। দ্রুত অপারেশন না করলে টিউব ফেটে গর্ভবতী মায়ের মৃত্যু হতে পারে।

ওয়ার্ডের একজন সিনিয়র নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ইকটোপিক প্রেগনেন্সির রোগীগুলো হাসপাতালে ভর্তি হলেও তাড়াতাড়ি তাদের অপারেশন মেলে না।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চন্দনাইশ গাছবাড়িয়ার হাসনার সঙ্গে গত শনিবার আলাপ করে জানা যায়, তিন চার বছর ধরে তার তলপেটে ব্যথা হতো। রক্তক্ষরণ হতো। পরীক্ষা করে জানা গেছে, তার ডিম্বাশয়ে টিউমার হয়েছে। তার অপারেশনের তারিখ পড়েছে ২২ জানুয়ারি। কিন্তু দুদিন ধরে তার গায়ে প্রচন্ড জ্বর। হাসপাতালে তিনি ভর্তি আছেন প্রায় ১৫ দিন ধরে। একমাসেও অপারেশন তার কপালে আছে কিনা তিনি জানেন না।

অপারেশনের তারিখ দেরিতে পড়া প্রসঙ্গে চমেকের গাইনি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শাহানারা বেগম জানান, ‘আমাদের করার কিছু নেই। অপারেশন থিয়েটারের স্বল্পতা ও চিকিৎসক সংকটেই দেরি হয়ে যায়। আর সরকারি হাসপাতালে এর চেয়ে ভালো আর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভবও নয়।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!