হুমকিতে জনস্বাস্থ্য/ দোকানে দোকানে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের স্তূপ চট্টগ্রামে

হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ফার্মেসি থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সরিয়ে নেওয়ার কথা থাকলেও চট্টগ্রামে অনেক ফার্মেসিতে এ ধরনের ওষুধ দেখা গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোম্পানিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ফেরত নিতে চায় না। ফলে দিন দিন মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের স্তূপ জমে যায়। আবার অসচেতনতার কারণেও প্রতিমাসে অবিক্রিত অনেক ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়। বছর শেষে সেটি মোটা অংক হয়ে দাঁড়ায়। ফার্মেসি মালিকেরা বাধ্য হয়ে এসব মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ মানুষের কাছে বিক্রি করে দেন। চিকিৎসকদের অভিমত, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ গ্রহণে মানবদেহে ভয়ানক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান ফটকে অবস্থিত জনতা ফার্মেসিতে সানফার্মা, এলবিয়ন, প্যাসিফিক, সনোফি ফার্মাসিউটিক্যালস মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ দেখা গেছে। অন্যদিকে পূর্ব ফটকের ফাতেফা ফার্মেসিতে নোভার্টিস, অপসোসেলাইন, সনোফি, প্যাসিফিক, এভেন্টিস, পপুলারের ও জনকল্যাণ ফার্মেসিতে একমি, সেন্টিয়ন ফার্মা, নাভানা, গ্লোবের এবং জমজম ফার্মেসিতে সনোফি, সানফার্মা, ইউনাইটেড, হামদর্দ, সোমাটেক, এমভি ফার্মা, পপুলারের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ দেখা গেছে। এছাড়া চকবাজারের এমসিএম ফার্মেসিতে একমি, গ্লোব, নেপ্রোজেএমআই ও প্যাসিফিক ফার্মাসিউটিক্যালসের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ দেখা গেছে।

জানা গেছে, ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্দেশনা অনুসারে ফার্মেসি মালিকেরা এসব মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের তালিকা প্রস্তুত করে রেখেছেন। ফার্মেসি মালিকরা জানান, ওষুধ প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধিরা এসব ওষুধ নিয়ে যাবে বলেও নিয়ে যায় না।

চট্টগ্রামের পাইকারি ওষুধের বৃহৎ বাজার হাজারী লেইন। এখান থেকে প্রতিদিন অন্তত চার কোটি টাকার ওষুধ পুরো চট্টগ্রামে বিক্রির জন্য নিয়ে যান খুচরা বিক্রেতারা। হাজারী গলিতে প্রায় ৫০০ ওষুধের দোকান রয়েছে। ওষুধের বৃহৎ বাজার হওয়ায় এখানে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো সরাসরি ওষুধ বিক্রি করে। তাছাড়া কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিরাও অঞ্চলভিত্তিক টার্গেট পূরণের জন্য হাজারী গলিতে ওষুধ বিক্রি করে থাকেন। জানা যায়, হাজারী গলিতে জেলার বিভিন্ন এলাকার বিক্রয় প্রতিনিধি বা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেনা ওষুধে কোম্পানির দেওয়া চালান না থাকায় কোম্পানিগুলো পরে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ফেরত নিতে চায় না। ফলে বছর শেষে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের স্তূপ জমে যায়।

ওষুধ ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে বলেন, নির্দিষ্ট এলাকায় টার্গেট অনুযায়ী ওষুধ বিক্রি করাটা কোম্পানিগুলোর পলিসি। তাদের পলিসির কারণে আমরা কেন ভুক্তভোগী হব? কোম্পানিগুলো যদি তাদের বিক্রয় প্রতিনিধিদের সেলের (বিক্রি) জন্য অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ না করেন, তাহলে তারা এলাকার বাইরে গিয়ে ওষুধ বিক্রি করবে না। কোম্পানিগুলোর উচিত, তাদের মেয়াদোত্তীর্ণ সব ওষুধ নিয়মিত তুলে নেওয়া।

হাজারি গলি ঘুরে দেখা যায়, কোম্পানিগুলো তাদের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নিয়ে গেলেও কয়েকটি ফার্মেসিতে ফেরত নেবে বলেও এখনও নিয়ে যায়নি।

ব্যবসায়ীরা বলেন, ফার্মেসিগুলো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর সাথে ব্যবসা করে। কোম্পানি প্রতিনিধিরা ফার্মেসিতে লেনদেন করেন। অসচেতনতার কারণে প্রতিমাসে অবিক্রিত অনেক ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়। বছর শেষে সেটি মোটা অংক হয়ে দাঁড়ায়। ফার্মেসি মালিকেরা বাধ্য হয়ে এসব মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ মানুষের কাছে বিক্রি করেন।

কয়েকজন ব্যবসায়ী মতপ্রকাশ করেন, সব ব্যবসায়ীরই উচিত মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ তাক থেকে সরিয়ে একটি বাক্সে ‘বিক্রয়ের জন্য নয়’ লিখে দোকানের একটি নির্দিষ্ট স্থানে জায়গায় রেখে দেওয়া। মাস শেষে কোম্পানিগুলো এসব অবিক্রিত ওষুধ নিয়ে যাবে। অনেক কোম্পানি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ তুলে নিয়ে না যাওয়ার কারণে ফার্মেসি মালিকেরা অনৈতিকভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ক্রেতার নিকট বিক্রি করে থাকেন।

সম্প্রতি ওষুধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কঠোর অবস্থানের কারণে নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ দেশের সকল ফার্মেসি থেকে তুলে নিতে নির্দেশ দেয়। ওষুধ ব্যবসায়ী সমিতি ও ফার্মেসি মালিকদের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ না রাখতে চিঠি দিয়ে নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সারা দেশে প্রায় সব কোম্পানি মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ তুলে নেওয়ার কাজ শুরু করে। তবে ওষুধ ব্যবসায়ীদের দাবি, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ প্রতিমাসেই তুলে নেওয়া উচিত।

মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ গ্রহণ করলে কী ক্ষতি হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জাকের হোসেন বলেন, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ মানবদেহের জন্য চরম ক্ষতিকর। অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণও। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি একটি অনৈতিক কাজ। ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নিয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতাও জরুরি।

হাজারী লেইন ওষুধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি শফিউল আজম বলেন, ‘মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ব্যাপারে আমরা সকল ব্যবসায়ীকে সতর্ক করেছি। কোম্পানিগুলো তাদের মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ তুলে নিয়ে গেছে। যারা নিয়ে যায়নি তাদের ব্যাপারে প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেবে।’

ওষুধ প্রশাসনের চট্টগ্রাম তত্ত্বাবধায়ক কামরুল হাসান বলেন, ‘হাইকোর্টের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে প্রত্যেক কোম্পানিগুলোকে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ তুলে নিতে বলা হয়েছে। যারা নেবে না তাদের ব্যাপারে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

উল্লেখ্য, ১০ জুন ঢাকায় বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালরক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেছিলেন, ঢাকার ৯৩% ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রয় করা হয়। পরে ১৮ জুন হাইকোর্ট ২ জুলাইয়ের মধ্যে দেশের সকল ফার্মেসি থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। ওইদিন এক রিট আবেদনের শুনানিতে হাইকোর্টের বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

এসএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!