মেয়র মুজিবের গায়ে দুর্নীতির গন্ধ, হাজার কোটি টাকার শেকড় খুঁজবে দুদক

হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির গন্ধ এখন কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমানের গায়ে। বিশাল এই দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করতে অবশেষে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৮ সালে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দুর্নীতি ও দখলবাজির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি— এমন অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। কমিশনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গত ১১ অক্টোবর মহাপরিচালককে (তদন্ত-২) চিঠি দিয়েছেন দুদকের পরিচালক উত্তম কুমার মন্ডল।

দুর্নীতি দমন কমিশনে যাওয়া অভিযোগ থেকে জানা যায়, পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতির নানা অভিযোগ ওঠে আসছিল। অভিযোগের মধ্যে অন্যতম হল শহরের ঝাউতলাস্থ হোটেল সী-কুইন মার্কেটের সাথে লাগোয়া সমবায় মার্কেট নির্মাণ করে সরকারি কোষাগারে নামমাত্র পে-অর্ডার জমা করে প্রত্যেক দোকানের ভাড়াটিয়া মালিক থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায়, একইভাবে বাস টার্মিনালে দোকান নির্মাণ করে সরকারি কোষাগারে নামমাত্র পে-অর্ডার জমা করে প্রত্যেকটি দোকান থেকে ১০-১৫ লাখ করে নগদ টাকা আদায়, বাঁকখালী নদীর তীর দখল করে গরুর খামার, কক্সবাজার পৌরসভায় টমটমের (ইজিবাইক) লাইসেন্স বিক্রি করে অর্ধশত কোটি টাকা আয়, পৌরসভার প্রত্যেক উন্নয়ন প্রকল্প থেকে তার মনোনীত ইঞ্জিনিয়ার টিটনের মাধ্যমে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমিশন আদায়।

মেয়র মুজিবের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের মধ্যে আরও রয়েছে— সুগন্ধা পয়েন্টের সরকারি খাসজমির ওপর ৬০টি দোকান ও ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কলাতলীর সরকারি খাসজমিতে কাঁচা ভবন নির্মাণ, ব্যক্তিমালিকানাধীন ১০টি হোটেল ও রিসোর্ট দখল এবং চাঁদা আদায়, অনিয়মের মাধ্যমে কক্সবাজার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে অর্থ উত্তোলন, ২৬টি মেগা প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে ঘুষ গ্রহণ, ঘুষ নিয়ে কক্সবাজারে দুটি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য এবং কক্সবাজার পৌরসভার ৪৪টি উন্নয়নমূলক কাজ থেকে ১০ শতাংশ ঘুষ গ্রহণসহ সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ ও অর্থ পাচার।

এছাড়াও হোটেল-মোটেল জোনের ইকরা মিজান নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে মেয়র মুজিবুর রহমান ৫০০ কোটি টাকা দুবাইয়ে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার স্ত্রীর কাছে ১০০ ভরি স্বর্ণ আছে— এমন অভিযোগও রয়েছে।

তবে এসব অভিযোগ রাজনৈতিক ও প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসা— এমন উল্লেখ করে মেয়র মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘এসব অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ। আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি দুদক বা যে কোনো সংস্থা কিংবা ব্যক্তি যদি আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার, হোটেল দখলের একটি অভিযোগও প্রমাণ করতে পারে, তাহলে আমি মেয়র ও কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করব।’

মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আমার ব্যবসা এবং সব কাগজপত্র আয়নার মতো পরিস্কার। দুদক এর আগেও আমার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছিল, তখন কোন ধরনের অনিয়ম পায়নি। আশা করি ভবিষ্যতেও পাবে না।’

এদিকে এর আগে দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগে গত ২১ মার্চ মেয়র মুজিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগের মধ্যে ছিল বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি, পানি শোধনাগার প্রকল্পে দুর্নীতি, সরকারি জমিতে মার্কেট নির্মাণ করে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, অর্থ পাচার, অবৈধ সম্পদ অর্জন ইত্যাদি। ওই সময় দুদকের উপপরিচালক মো. আলী আকবর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান সে সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান কর্মকর্তা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। অনুসন্ধানে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অভিযোগে জানা যায়, ভূমি অধিগ্রহণের নামে কক্সবাজারের তিনটি মেগা প্রকল্পে সংঘটিত হয়েছে ৭৮ কোটি টাকার দুর্নীতি। এ দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ১৪০ জনকে চার্জশিটভুক্ত আসামি, ১৫ জনের বিরুদ্ধে নতুন মামলা এবং ৯৬ জনের বিরুদ্ধে সম্পদ অনুসন্ধানের নোটিশ করার অনুমতি চেয়ে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে তিনটি তদন্ত প্রতিবেদন গিয়েছিল গত বছরের ৩০ জুন। কিন্তু ৬২০ পৃষ্ঠার সেই তিন তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা পড়ায় ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন ৭৮ কোটি টাকা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রধান হোতারা।

তিন তদন্ত প্রতিবেদনে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তাদের বেশিরভাগই রাঘববোয়াল। এদের মধ্যে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমানসহ রাজনীতিবিদ রয়েছেন সাতজন, চেয়ারম্যান দুজন, জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটসহ প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ২০ জন, পুলিশ সুপারসহ পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তা চারজন, সার্ভেয়ার ২৩ জন, কানুনগো আছেন সাতজন। এ ছাড়া তহশিলদার ছয়জন, সাব-রেজিস্ট্রার দু’জন, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা ছয়জন ও ব্যাংকের ম্যানেজার রয়েছেন তিনজন। এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করতে তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছিলেন চাকরিচ্যূূত দুদক কর্মকর্তা শরিফ উদ্দিন। শরিফ উদ্দিনের এ তিনটি তদন্ত প্রতিবেদন আমলে না নিয়ে ওই সময় তা পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেন কমিশন।

এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর) চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত এক মানববন্ধনে বক্তারা অভিযোগ করেন, ‘কক্সবাজারে সরকারের তিন দশমিক পাঁচ লাখ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পে দুর্নীতি ধরতে গিয়ে দুদক কর্মকর্তা শরিফ উদ্দিন চাকরি হারিয়েছেন। এসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কমিশন বরাবরে প্রায় ৬০০ পাতার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ায় প্রথমে তাকে বদলি, পরে পদোন্নতিবঞ্চিত করা হয়। পরে তাকে অসাংবিধানিক, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে চাকরি থেকে অপসারণও করা হয়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!