মেয়র নাছিরের ৩৬ দফা প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগই অধরা

২০১৫ সালে চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের আগে ‘মেগাসিটির’ স্বপ্ন পূরণে ৩৬ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দীন। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর গত ৫ বছরে এ সকল প্রতিশ্রুতির বেশিরভাগই রয়ে গেছে অপূর্ণ। উল্টো প্রতিশ্রুতির বিপরীতমুখী কাজ করে নানা সময়ে সমালোচিত হয়েছেন চট্টগ্রামের এ মেয়র। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিকভাবে সমালোচনার মুখে পড়া মেয়র নাছির নির্বাচনী ইশতেহার পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন থেকে ছিটকে পড়তে পারেন।

জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল নগরীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিন ‘স্বপ্নের মেগাসিটি গড়তে চাই, জলাবদ্ধতামুক্ত জনবান্ধব চট্টগ্রাম’ শিরোনামে ৩৬ দফা উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা তুলে ধরেছিলেন।

যা যা ছিল নাছিরের ইশতেহারের ৩৬ দফায়
জলাবদ্ধতা নিরসন, সমগ্র নগরীতে ওয়াইফাই জোন, পাহাড় রক্ষা ও বনায়ন, পানি দূষণ রোধ, পানি সংকট নিরসন, কর্ণফুলি নদী রক্ষা করা, শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, তথ্য প্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিতকরণ, শিক্ষার্থীদের বাসভাড়ায় ভর্তুকি, নারীদের জন্য বাস সার্ভিস চালু, আবাসন সংকট নিরসন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ক্রীড়া ও বিনোদন ব্যবস্থার উন্নয়ন, মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠন, সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ, গণশৌচাগারের উন্নয়ন, ভিক্ষাবৃত্তি বিমোচন, দারিদ্র্য বিমোচন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধ, আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ, শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা, প্রান্তিক মানুষের সুবিধা বৃদ্ধি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সংকট নিরসন, ফরমালিনমুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা, আধুনিক কসাইখানা স্থাপন, গরীব মানুষের জন্য বহুতল ফ্ল্যাট, নিরাপত্তা ব্যবস্থা আধুনিক করা, শিশুবান্ধব নগর, ধর্মীয় সুবিধা প্রদান, তরুণ-যুবা-নারী সমাজকে কর্মমুখী করা, কৃষকদের প্রণোদনা প্রদান, ল্যাবরেটরি স্থাপন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং টেকসই উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের পরিকল্পনাও তুলে ধরেন।

৫ বছর আগে ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে এভাবেই ঘোষণা করেছিলেন বিশাল নির্বাচনী ইশতেহার।
৫ বছর আগে ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে এভাবেই ঘোষণা করেছিলেন বিশাল নির্বাচনী ইশতেহার।

জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থতা
নির্বাচনের পূর্বে জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরবর্তীতে জলাবদ্ধতার দায় অস্বীকার করেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। এমনকি সিটি কর্পোরশনের প্রস্তাবিত জলাবদ্ধতা নিরসনের বিশেষ প্রকল্প সরকার থেকে অনুমোদন আনতেও ব্যর্থ হন মেয়র নাছির। পরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তাদের প্রস্তাবিত ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প সরকার থেকে অনুমোদন করিয়ে আনে।

হদিস নেই ওয়াইফাই জোনের
তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে সমগ্র নগরীতে ওয়াইফাই জোন করার প্রতিশ্রুতি এসেছিল মেয়র নাছিরের নির্বাচনী ইশতেহারে। নির্বাচিত হওয়ার পর আদালত ভবন এবং চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজকে (চমেক) ওয়াইফাই’র জোন ঘোষণা করলেও তা তা বেশি দিন সচল থাকেনি। সর্বশেষ গত ২ ফেব্রুয়ারি একটি অনুষ্ঠানে মেয়র নাছির আবারও চট্টগ্রামকে ওয়াইফাই জোনের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দেন।

রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাহাড় কাটা
পাহাড় রক্ষা ও বনায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়র নাছির নির্বাচিত হলেও গত ৫ বছরে পাহাড় কাটার অভিযোগ ছিল খোদ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) বিরুদ্ধে। প্রকাশ্যে নির্বিচারে পাহাড় কেটে লেক সিটি আবাসন প্রকল্প নির্মাণ করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।

কর্ণফুলী নদী রক্ষায় ছিল না উদ্যোগ
কর্ণফুলী নদী রক্ষা করার জন্য নানা উদ্যোগের কথা নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করেছিলেন বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। কিন্তু এ প্রতিশ্রুতিটি ইশতেহারেই ফাইলবন্দি ছিল গত ৫ বছর। কর্ণফুলী বাঁচাতে জেলা প্রশাসন বিভিন্ন সময় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলেও সিটি কর্পোরেশনের তেমন কোন উদ্যোগের দেখা মেলেনি।

শিক্ষাখাতের বাণিজ্য
শিক্ষার উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। কিন্তু চসিক পরিচালিত ৮৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গত ৫ বছরে শিক্ষা ব্যয় বেড়েছে নূন্যতম ৫ গুন। এ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ৬০ হাজার শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে এ নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে।

স্বাস্থ্য বিভাগেও ব্যর্থতা
সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে চসিকের স্বাস্থ্য বিভাগের সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার আমলে প্রতিটি ওয়ার্ডে আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রকল্পের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হলেও পরবর্তী মেয়ররা সে সুনাম ধরে রাখতে পারেননি। মেয়র নাছিরের ৫ বছরে চসিকের স্বাস্থ্যসেবা ছিল শূন্যের কোটায়। তবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে প্রতি ওয়ার্ডে এক হাজার পরিবারকে ‘মেয়র হেলথ কার্ড’ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পের সফলতা খুব একটা দেখা যায়নি।

৫ বছর আগে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এভাবে প্রচারণা চালিয়েছিলেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। মেয়রের ফেসবুক পেইজ থেকে নেওয়া ছবি।
৫ বছর আগে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এভাবে প্রচারণা চালিয়েছিলেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। মেয়রের ফেসবুক পেইজ থেকে নেওয়া ছবি।

ভাড়ায় ভর্তুকির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ
সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে নগরীতে শিক্ষার্থীদের জন্য বাসভাড়ায় ভর্তুকির কথা থাকলেও এ বিষয়ে মেয়র নাছিরকে কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।

গরিবের ফ্লাট দখল করে চসিক কার্যালয়
নির্বাচনের ইশতেহারে গরিব মানুষের জন্য বহুতল ফ্ল্যাট নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলেও উল্টো কাজটি করেছেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। মেয়র এম মনজুর আলমের আমলে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের বহুতল ভবন ২০১৯ সালের ১৮ জুন দখলে নিয়ে কার্যালয় বানিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এ নিয়ে গরিব ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়।

শিশু ও ক্রীড়াবান্ধব নগরী গড়তে ব্যর্থ
ইশতাহেরের শিশু ও খেলাধুলার উপযোগী নগরীর গড়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও আ জ ম নাছির উদ্দিনের ৫ বছরে একের পর এক ধ্বংস হয়েছে নগরীর উন্মুক্ত মাঠসহ বিনোদনের পার্ক। নগরীর আউটার স্টেডিয়ামের খোলা উদ্যানে সুইমিংপুল বানিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েন মেয়র নাছির। এছাড়াও পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার জাতিসংঘ পার্কটিও ধ্বংসের চূড়ান্ত পর্যায়ে।

তথ্যপ্রযুক্তিতে স্বনির্ভরতা কোথায়?
ডিজিটাল চট্টগ্রাম গড়তে নগর ভবনে বিল প্রদানে স্মার্ট কার্ড স্কিম বাস্তবায়নের ওয়াদা ছিল নির্বাচনী ইশতেহারে। গত ৫ বছরে সে ওয়াদা রাখতে পারেনি মেয়র নাছির।

এছাড়াও মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের নির্বাচনী ইশতেহারে থাকা আরো যে সকল প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি— তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পানি দূষণ রোধ, পানি সংকট নিরসন, নারীদের জন্য বাস সার্ভিস চালু, আবাসন সংকট নিরসন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন, মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠন, সামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ, ভিক্ষাবৃত্তি বিমোচন, দারিদ্র্য বিমোচন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধ, শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা, প্রান্তিক মানুষের সুবিধা বৃদ্ধি, ব্যবসা-বাণিজ্যের সংকট নিরসন, ফরমালিনমুক্ত বাজার ব্যবস্থাপনা, তরুণ-যুবা-নারী সমাজকে কর্মমুখী করা, কৃষকদের প্রণোদনা প্রদান, ল্যাবরেটরি স্থাপনের প্রতিশ্রুতি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!