‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা চীনা পণ্য এনে বিদেশে পাঠায় চট্টগ্রাম ইপিজেডের ‘কন্ডা’, শত কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি

আমদানির পরতে পরতে অভিনব কৌশলে বিশাল অংকের শুল্ক ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম ইপিজেডে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান কন্ডা আর্ট ম্যাটেরিয়ালস বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড। গত বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১৬ মাসে ১৯১টি বিল অব এক্সপোর্ট ও একই পরিমাণ বিল অব ইমপোর্ট হয়েছে কন্ডা আর্ট ম্যাটেরিয়ালসের নামে। এই ১৯১ কনসাইনমেন্ট বা চালানের প্রতিটিতেই শুল্ক ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে বলে সন্দেহ করছে কাস্টমস। এমন অবস্থায় ১৬ মাসের আমদানি ও রপ্তানির ১৯১টি চালানের কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে চট্টগ্রামের কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট। এর মধ্যে কয়েকটি চালানে প্রায় ২৬ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির তথ্য প্রমাণ পেয়েছে সরকারি সংস্থাটি। এ বিষয়ে ইতিমধ্যে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে চট্টগ্রাম ইপিজেডের ৪ নম্বর সড়কে অবস্থিত কন্ডা আর্ট ম্যাটেরিয়ালস বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃপক্ষকে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের তদন্তে ওঠে আসে, ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পণ্য চীন থেকেই আমদানি করে আবার একই চালান বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি দেখায় প্রতিষ্ঠানটি। অথচ কাঁচামাল আমদানি করে ইপিজেডে তৈরি করে পুনরায় পণ্যটি বিদেশে রপ্তানি করার কথা। কিন্তু কাঁচামাল নয়, বরং তৈরিকৃত পণ্য আমদানি করে পুনরায় রপ্তানি করছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ক্ষেত্রে তৈরি পণ্যে চালানের যে পরিমাণ শুল্ককর দেওয়ার কথা, তার পুরোটাই ফাঁকি দিয়েছে ‘কন্ডা আর্ট ম্যাটেরিয়ালস বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড’। এর মধ্যে মিথ্যা ঘোষণা বা চালানের ওজনে নয়-ছয় আছেই।

সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এসব জালিয়াতির সঙ্গে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজস রয়েছে। এ অপকৌশলে শুল্কফাঁকি ও আমদানিতে জালিয়াতির কারণে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

জানা গেছে, ইপিজেডের ওই কারখানাটি আর্ট পেপার, ড্রয়িং ক্যানভাস, পেইন্টিং সেট, প্যাড, রং, পিকচার বই, ব্রাশ ইত্যাদি পণ্য বানিয়ে রপ্তানি করে থাকে। এসব পণ্য ইউরোপ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাতে রপ্তানি হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ‘কন্ডা আর্ট ম্যাটেরিয়ালস বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড’ বেপজার কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় বড় অঙ্কের সরকারি শুল্ক ফাঁকি দিতে চীন থেকে ১০ কাভার্ড ভ্যানভর্তি পণ্য নিয়ে এসেছে মিথ্যা ঘোষণায়।

এর মধ্যে গত এপ্রিল মাসে ১০টি কাভার্ড ভ্যান ও মে মাসে সাত কনটেইনার পণ্য আমদানিতে শুল্ক ফাঁকি ও কাগজপত্রে অসঙ্গতির আংশিক প্রমাণ পেয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা কাভার্ড ভ্যানগুলো জব্দ করেন। জালিয়াতির গন্ধ পেয়ে গত বছর থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সব চালানের তদন্তও শুরু করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কাস্টমস বন্ড।

কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা ১০ কাভার্ডভ্যান ছাড়াও পণ্য আমদানি করে বড় অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি, অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ মিলছে কন্ডা আর্ট ম্যাটেরিয়ালস বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের কাগজপত্রেই।

গত ১৭ এপ্রিল কাস্টমস বন্ডের উপ-কমিশনার তপন কুমার চক্রবর্তীর দেওয়া এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালের সমীক্ষা রিপোর্টে আমদানি করা কাঁচামালের তুলনায় রপ্তানি করা পণ্য ছিল বেশি। যদিও আমদানি করা পণ্য কাঁচামাল রয়ে গেছে ওয়্যারহাউসে। এক্ষেত্রে ১৪ কোটি ২৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকার আমদানি পণ্যে (কাঁচামাল) শুল্ককর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ৮ কোটি ৯ লাখ ৯৩ হাজার টাকা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফিনিশড্ ব্রাশ সেট আমদানি করে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা আর্ট ম্যাটেরিয়াল সেট (ব্রাশ) আবার রপ্তানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছরের মে মাসে এরকম তিনটি কটেইনার জব্দ করে করেছে কাস্টমস হাউস। সেখানে কোনো ধরনের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ছাড়াই তৈরি ব্রাশ পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রেই শুধু শুল্ককর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ১৩ কোটি ৪৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। ঠিক একই ধরনের ১২৩টি চালান বিদেশে রপ্তানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। যার নিট ওজন ৫৪ হাজার ৪৩৩ কেজি।

একইভাবে আর্ট ম্যাটেরিয়ালস সেট (ব্রাশ) ও আট ম্যাটেরিয়ালস সেট (ক্যানভাস) নামে ১৯১টি পণ্য চালান রপ্তানি করেছে ‘কন্ডা আর্ট ম্যাটেরিয়ালস’। যার মোট ওজন ২,০০,৭৯৭.৯২ কেজি।

অপরদিকে ওই প্রতিষ্ঠানটি ২ কোটি ৩৬ লাখ ৫৮ হাজার ১৩৬ পিস ব্রাশ আমদানি করার পর আবার রপ্তানি করেছে ১ কোটি ২ লাখ ৯৪ হাজার ৪৬০ পিস। এই হিসেবে আরও ১ কোটি ৩৩ লাখ ৬৩ হাজার ৬৭৬ পিস কোম্পানির কাছে মজুদ থাকার কথা, কিন্তু অনুসন্ধানে সেই মজুদের অস্তিত্ব মেলেনি। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি শুল্কফাঁকি দিয়েছে ৪ কোটি ৫০ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।

কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, এসব বিষয়ে কাস্টমস অ্যাক্ট ১৯৬৯-এর বিভিন্ন ধারায় বন্ড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধিমালা ২০০৮-এর শর্তাবলী লঙ্ঘন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে গত ৮ আগস্ট কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট চট্টগ্রামের কমিশনার একেএম মাহবুবুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি নোটিশ পাঠানো হয় প্রতিষ্ঠানটির কাছে। পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ের ওপর জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট চট্টগ্রামের কমিশনার একেএম মাহবুবুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কন্ডা আর্ট ম্যাটেরিয়ালস বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের বিরুদ্ধে শুল্ককর ফাঁকির বিষয়টি শুনানির পর্যায়ে রয়েছে। বিভিন্ন অনিয়মের প্রমাণ মিললেও উক্ত প্রতিষ্ঠানের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রয়েছে। শুনানি শেষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!