মিরসরাইয়ে পাহাড়ি ঝরনায় দুই বছরে নিহত ৪, আহত অর্ধশত

মিরসরাইয়ে পাহাড়ি ঝরনায় দুই বছরে নিহত ৪, আহত অর্ধশত 1মিরসরাই প্রতিনিধি : নজরকাড়া পাহাড়ি ঝরনার কারণে মিরসরাইয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঝরনা দেখার জন্য মিরসরাইয়ে আসছেন পর্যটকেরা। উপজেলার ৯ স্তরবিশিষ্ট খইয়াছড়া, নাপিত্তাছড়া, সহস্রধারা, মহামায়া, বাওয়াছড়া, কমলদহ ছড়া, সোনাইছড়ি ঝরনা নজর কেড়েছে ভ্রমণ পিপাসু মানুষের। তবে ঝরনাগুলোতে প্রশাসনের কোনো নজরদারি না থাকায় একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রতিদিন হাজারো মানুষ ঝরনার পানিতে একটু শরীর ভিজিয়ে নিতে ছুটে যাচ্ছেন। ঝরনার পানি থেকে সৃষ্ট লেকে সাঁতার কাটার সময় গত দুই বছরে মৃত্যু হয়েছে চারজন পর্যটকের। আহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশত।

সর্বশেষ গত ১০ নভেম্বর উপজেলার নাপিত্তাছড়া ঝরনায় সাঁতার কাটার সময় চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন মামুনের (২২) মৃত্যু হয়। তিনি ফেনী জেলার শৈর্শদী এলাকার মতিউর রহমানের ছেলে। পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম থেকে আসা ফায়ার সার্ভিসের বিশেষ ডুবুরি দল মামুনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে মিরসরাই থানা পুলিশের হাতে লাশ হস্তান্তর করে। ঝরনায় যাওয়ার পথ দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটলে সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ঝরনা এলাকায় মাঝে মধ্যে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন পর্যটকেরা।

জানা গেছে, গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর খইয়াছড়া ঝরনা দেখতে গিয়ে পাহাড় থেকে পড়ে আবুল কালাম আজাদ নামে এক যুবক আহত হন। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাকে উদ্ধার করেন।

আজাদের বন্ধু সায়মুন মাহমুদ জানান, তারা ছয় বন্ধু কুমিল্লা থেকে ঝরনা দেখতে আসেন। খইয়াছড়া ঝরনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঝরনা দেখে তৃতীয় ঝরনা দেখতে আজাদ পাহাড়ের ওপরে ওঠেন। এ সময় পা পিছলে তিনি পাহাড়ের প্রায় দেড় কিলোমিটার নিচে পড়ে একটি গাছের সাথে আটকে যান। এ বছরের ১৫ আগস্ট নয়দুয়ারিয়া নাপিত্তাছড়া ঝরনার কূপে ডুবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনিমেষ দে (২৭) নামে এক পর্যটক নিহত হয়েছেন। তিনি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার নিরঞ্জন দের ছেলে। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল তাকে উদ্ধার করে।

অনিমেষের বন্ধু তানভীর আলম জানান, তারা তিন বন্ধু চট্টগ্রামের অক্সিজেন এলাকা থেকে নয়দুয়ার এলাকায় নাপিত্তাছড়া পাহাড়ি ঝরনা দেখতে আসেন। পাহাড়ের ওপর থেকে নামার পথে পা পিছলে অনিমেষ দে কূপে পড়ে যান। ২৪ আগস্ট দক্ষিণ ওয়াহেদপুর রূপসী ঝরনায় ওপর থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান সাইফুল ইসলাম নামে এক যুবক। তার বাড়ি সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া এলাকায়।

গত ১৭ জুলাই মহামায়া লেকে পানিতে ডুবে মারা যান শাহাদাত হোসেন (২২) নামে এক যুবক। তিনি মিরসরাই উপজেলার সদর ইউনিয়নের গড়িয়াইশ গ্রামের মৃত আলী আহম্মদের ছেলে। ১৫ জুলাই খইয়াছড়া ঝরনার সপ্তমস্তরের পঞ্চমস্তরে ওঠার পর স্থানীয় এক পর্যটক পিছলে পড়ে যাওয়ার সময় তাকে ধরতে গিয়ে পাহাড়ের নিচে পড়ে যান অপর পর্যটক ওয়াসিম আসগর। ওই পর্যটক সামান্য আঘাত পেলেও ওয়াসিম পাহাড়ের নিচে পড়ে যান। পরে মিরসরাই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আহত পর্যটককে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেক্সে ভর্তি করেন।

জানা গেছে, কিছু বিষয়ে সতর্ক না থাকায় অনেক সময়ই ঘটে যাচ্ছে দুর্ঘটনা। পর্যটকদের অসতর্কতার জন্য ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা। তাই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ বেশ কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন মিরসরাই উপজেলা ও থানা প্রশাসন। নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়া খেয়ালখুশি মতো গহিন জঙ্গলসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে এলোমেলোভাবে বেড়াতে গিয়ে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ছে। এর জন্য অনেকেই দর্শনার্থীদের দায়িত্বহীনতা ও অসংযত আচরণকে দায়ী করছেন।

তবে সম্প্রতি পর্যটকদের নিরাপদে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিতে ইকো গাইড ভাড়া দেয়ার পাশাপাশি পাহাড়ে ওঠার জন্য জুমারিং ও নামার জন্য র্যাপ্লিং ভাড়া দিয়ে পর্যটকদের নজর কেড়েছেন বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যান সহব্যবস্থাপনা কমিটি।

বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যান সহব্যবস্থাপনা কমিটি (সিএমসি) সভাপতি মো: সরওয়ার উদ্দিন বলেন, আমরা পর্যটকদের জন্য সচেতনতামূলক সাইনবোর্ড স্থাপন করেছি। খৈয়াছড়া, সহস্রধারা, নাপিত্তা ছড়া, লবণাক্ষছড়া, বাউয়াছড়া, কমলদহছড়া, সোনাইছড়া ঝরনা এলাকায় নিরাপদে যাওয়ার জন্য ২০ জন ইকো গাইডকে নিয়োগ দিয়েছি। পর্যটকেরা যদি ঝরনা এলাকায় যাওয়ার সময় ইকো গাইডদের সাথে নিয়ে যান তাহলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।

খইয়াছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, মূলত দায়িত্বহীনতা ও অসাবধানতার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে। অনেকে ঝরনার ওপরে উঠে সেলফি তুলতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যান।

উপজেলা প্যানেল চেয়ারম্যান-২ ইয়াছমিন আক্তার কাকলী বলেন, মিরসরাইয়ের বিভিন্ন পাহাড়ে সৃষ্ট ঝরনা দেখতে প্রতিদিন আসেন হাজারো পর্যটক। ঝরনা এলাকাগুলোতে যদি পর্যটন মন্ত্রণালয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে তাহলে প্রতি বছর কয়েক কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করা সম্ভব।

এখানে কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকায় ইতোমধ্যে কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমরা পর্যটন এলাকাগুলোতে বিপজ্জনক স্থান চিহ্নিত করে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শিগগিরই সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড দেবো।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!