মিন্টুই মীর কাসেম! ডাক নাম পিয়ারু! আলোচিত জল্লাদখানার নৃশংস কাহিনী : ডালিম হোটেলের কান্না থামল

রাজীব সেন প্রিন্স : বিশেষ প্রতিনিধি ::

প্রসিকিউশনের তথ্য মতে একাত্তর সালে চট্টগ্রামের মানুষের কাছে সুপরিচিত মিন্টুই মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের মীর কাসেম। ডাক নাম পিয়ারু। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালী নিধন পর্ব শেষে স্বাধীনতার পর ঢাকায় পালিয়ে গিয়ে নিজেকে মিন্টু নামে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টা চালায় সে। চট্টগ্রামের মানুষ তখন তাকে মিন্টু নামে চিনতো। কিন্তু আসল মুখোশ উন্মোচন হয়ে গেলে সে দেশের বাইরে লন্ডনে পালিয়ে যায়।

 

1414995510_th

মুক্তিযুদ্ধের সময় মিন্টুর নেতৃত্বে আলবদর সদস্য ও রাজাকাররা চট্টগ্রামের ডালিম হোটেল, আসাদগঞ্জের চামড়ার গুদাম ও পাঁচলাইশের সালমা মঞ্জিলে নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তোলে। এর মধ্য সবচেয়ে ভয়াল টর্চার সেল নামে পরিচিত হয়ে উঠে ডালিম হোটেল।

 

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামের সেই ডালিম হোটেলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মিন্টুর নির্দেশেই হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটানো হয়।

 

৪৩ বছর আগের সেই ভয়াল টর্চার সেল থেকে কোনো রকমে বেঁচে ফেরা মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ের গহিনে দ্রোহ ও দহনের আগুন জ্বালা কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে টর্চার সেলের মূল হোতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় বহাল থাকার কথা শুনে। ডালিম হোটেলের ভয়াল কান্না বুঝি কিছুটা হলেও ম্লান হয়েছে বলে মনে করছেন তৎকালীন টর্চার সেলে নৃশংসতার শিকার প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন চৌধুরী। তবে এখনো ডালিম হোটেলের কথা শুনলে ভয়ে আৎকে উঠছেন তিনি।

 

ডালিম হোটেলের নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রয়াত এ সাংবাদিক বলেন, ডালিম হোটেলের একটি রুমে চোখ বেঁধে অন্য বন্দিদের সাথে আমাকেও রাখা হতো। মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে নানান তথ্য আদায় করার নাম করে প্রচুর মারধর করত। প্রতিদিনই চলত অমানুষিক নির্যাতন। কান্নার রোলে ভারি হয়ে উঠত পরিবেশ। আর এ নৃশংসতার মূল হোতা ছিলেন মীর কাসেম আলী।

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও এফএফ গ্র“প-১৫১ সেক্টর-১-এর কমান্ডার সিরু বাঙালি বলেন, চট্টগ্রামে বদর বাহিনীর মীর কাসেম আলীর নির্দেশনা ও নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্যাতন চালানো হতো। প্রতিদিন দিনে ও রাতে একবার সে ডালিম হোটেলে যেত। চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনীর মাস্টার মাইন্ড হিসেবে পরিচিত এ আলবদরের পৈশাচিক ও বর্বর নির্যাতনের চিত্র উঠে আসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ দেওয়া রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য-প্রমাণে।

 
বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা এবং গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, বদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষ নেতা হিসেবে ডালিম হোটেলকে ব্যবহার করত মীর কাসেমের টর্চার সেল হিসেবে। বাঙালিদের ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন চালাত। মুক্তিযোদ্ধাদের শরীর খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাত্ত করে উল্লাস করত বদর বাহিনী। তা মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তকালে তদন্তদলের প্রধান ও ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুর নেতৃত্বাধীন কমিটির সামনে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. গাজী সালাহ উদ্দিন। তিনি জানান, ১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও কাসেম আলীর সহযোগীরা পাহাড়তলীতে শত শত বাঙালিকে হত্যা করে।

a4f5efa11e0d74a90b58ec3e5b045718-57c52864b6503
২০০৬ সালের ৯ ডিসেম্বর দৈনিক সংবাদ পত্রিকার একটি সাক্ষাতকারে গণতন্ত্রী পাটির প্রয়াত নেতা সাইফুদ্দিন খান বলেছিলেন, চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধকালীন আলবদরদের ভয়াল টর্চার সেল নামে পরিচিত ডালিম হোটেলের ইনচার্জ ছিলেন, তৎকালীন আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রামের প্রধান ও জামায়েত নেতা মাওলানা আবু তাহের।

 

চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রগতিশীল ঘরানার ও মুক্তিবাহিনীর লোকজনকে ধরে ডালিম ভবনে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা এবং পটিয়া এলাকার আলবদর বাহিনীর প্রধান আবুল কালাম। নির্যাতন পরিচালনা করত ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ও আলবদরের প্লাটুন কমান্ডার এবং জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্য এনামুল হক মঞ্জু, ৭১ সালে চট্টগ্রাম জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা শামসুদ্দিন (ইসলামী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক) এবং ‘৭১ সালে বদর বাহিনীর প্লাটুন কমান্ডার বদিউল আলম (ইসলামী ব্যাংক পরিচালনা পরিষদের সাবেক সদস্য)। এছাড়া নির্যাতনকারীদের মধ্যে রাজাকার-আলবদরদের আরও অনেক সহযোগী ছিল।

 
তার নির্যাতন কাহিনী বর্ণনা দিতে গিয়ে তখন তিনি বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম শহরের কদমতলী বাস টার্মিনালের পাশে পোড়া মসজিদের সামনে আজিজ কলোনির বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন তৎকালীন জেলা ন্যাপের সভাপতি এ এন নূরুন্নবী, ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনের দুই কর্মকর্তা অরুণ কুমার চৌধুরী ও শফিউল আলম চৌধুরী, তার দুই ভাইপো ড. ইরশাদ কামাল খান এবং ড. মোসলেহ উদ্দিন খান। এরা দু’জন তখন চট্টগ্রাম কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।

 

মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিতে তারা সাইফুদ্দিন খানের কাছে এসেছিলেন। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে দুটি রুমে বিভক্ত হয়ে সকলে যখন ঘুমাচ্ছিলেন ভোরের দিকে সশস্ত্র অবস্থায় কিছু লোক এসে তাদের বাসায় ঢুকে ৬ জনকে চোখে কালো কাপড় এবং রশি দিয়ে হাত বেঁেধ রাস্তায় রাখা একটি মিনি ট্রাকে তুলে ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা এবং পটিয়া এলাকার আলবদর বাহিনীর প্রধান আবুল কালামের নের্তৃত্বে ‘মালাউনের বাচ্চা’ বলে লাথি দিয়ে ডালিম ভবনে নিয়ে যায়। সকালে ডালিম হোটেলের একটি অন্ধকার কক্ষে সবার চোখের কালো কাপড় খুলে দেয়া হয়।

 

চোখ খুলে দেখে সেখোনে আগে থেকেই বন্দী অবস্থায় রয়েছেন জেলা ন্যাপের তৎকালীন তুখোড় নেতা এডভোকেট শফিউল আলম (বেবী শফি), জাহাঙ্গীর চৌধুরী (বিএনপি নেতা দস্তগীর চৌধুরীর বড় ভাই), তৎকালীন চীনপন্থি ন্যাপ নেতা মো. সেলিম এবং সাংবাদিক মেজবাহ খানসহ মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকজন নেতা। কিছুক্ষণ পরে বন্দীদের পৃথক করে ফেলা হয়। এদের মধ্যে সাইফুদ্দিন খান, এ এম এন নূরুন্নবীসহ ১৩ জনকে রাখা হয়েছিল ডালিম ভবনের ছোট্ট একটি রান্নাঘরে। বেবী শফিসহ বাকিদের রাখা হয়েছিল অন্য একটি কক্ষে। দিনের অধিকাংশ সময় তাদের চোখ কালো কাপড়ে বেঁধে রাখত। তিনদিন পর ডালিম ভবন থেকে ইরশাদ কামাল খান, মোসলেহ উদ্দিন খান, ব্যাংক কর্মকর্তা অরুণ চৌধুরী ও শফিউল আলম চৌধুরীকে ছেড়ে দেয়া হয়।

 

রিপোর্ট : রাজীব সেন প্রিন্স

বিশেষ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম প্রতিদিন

এ এস / জি এম এম / আর এস পি :::

 

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!