মা-শিশুর ঝুলন্ত লাশ/ প্রতিবেশীরা অবাক, ধাঁধাঁয় পুলিশ—হত্যা নাকি আত্মহত্যা?

অন্য দিনের মতো রোববার সকালে চা-পরোটা নিয়ে শ্রীরঞ্জন সরকার নন্দন চলে যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। ভোর তিনটায় ঘুম থেকে ওঠে স্ত্রী লক্ষ্মী রাণী সরকার স্বামীকে সহযোগিতাও করেছিল চা-পরোটা তৈরি করতে। অন্যরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই লক্ষ্মী-নন্দন দম্পতি তাদের রুটি রুজির উপকরণ তৈরি করে নেন। কারণ একই রান্নাঘরে অন্য আরও ১১টি পরিবার রান্না করবে।

দেড়শ পরোটা আর ফ্ল্যাক্স ভর্তি সমপরিমাণ চা তৈরির গরম পানি নিয়ে নন্দন চষে বেড়ান চমেক হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ড। চা-পরোটা বিক্রি শেষে দুপুরে বাসায় ফিরেন। বিকেলের জন্য আবার চা তৈরি করে বিস্কুট নিয়ে এই পথে ঘুরে বেড়ান। চা বিক্রি শেষ হতে হতে কখনও রাত ১০টা কিংবা তারও বেশি সময় লেগে যায়। তারপর ফেরেন ঘরে। বউ লক্ষ্মী ছাড়াও তাদের সংসারে ছিল দুই বছরের সন্তান অনন্যা সরকার।

মাঝে মাঝে মন্দিরে যান, পার্কে বেড়াতেও। শুক্রবারও মন্দিরে পুজো দিয়ে এসেছিল নন্দন, লক্ষ্মী আর অনন্যা। কিন্তু রহস্যজনকভাবে তার তিনদিনের মাথায় স্বামী আজ একা পৃথিবীতে। একটি রশির একপ্রান্তে ঝুলে ছিলেন লক্ষ্মী আর অপরপ্রান্তে দুগ্ধপোষ্য শিশু অনন্যার মৃতদেহ।

রোববার বিকেলে ব্যবসা না করে নন্দন ঘুরতে গিয়েছিলেন পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে। বিকেল তিনটায় গাড়ি থেকে পতেঙ্গা নামার পরপরই স্ত্রী লক্ষ্মীর ফোন পান নন্দন। ফোন ধরার পর অপরপ্রান্ত থেকে লক্ষ্মী বলেছিল, ‘বাসায় আসো তাড়াতাড়ি’। এটুকু বলে লক্ষ্মী আর কথা বলেনি—জানালেন নন্দন।
এরপর নন্দন কয়েকবার ফিরতি ফোন করেন। স্ত্রীর সাড়া না পেয়ে সিএনজিচালিত ট্যাক্সি নিয়ে তিনি বাসায় ফেরেন।

শ্রীরঞ্জন সরকার নন্দন
শ্রীরঞ্জন সরকার নন্দন

তখন বিকেল চারটা। বাসার ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। ডাকাডাকিতে দরজা না খোলায় কৌশলে দরজা খোলেন চন্দন। দরজা খোলার পরের দৃশ্য দেখার জন্য পৃথিবীর কোন পিতা কিংবা স্বামী ভুলেও প্রস্তুত থাকেন না। নির্মম দৃশ্যটি হলো—একই রশিতে তার স্ত্রী লক্ষ্মী আর কন্যা অনন্যার লাশ ঝুলছে!

রোববার সন্ধ্যায় লাশ দুটি পাঁচলাইশ থানা উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য চমেক হাসপাতালের মর্গে পাঠালো। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নন্দনকে নিয়ে গেলো থানায়।

ষোলশহর মসজিদগলি লিচুবাগান এলাকায় গিয়ে দেখা গেলো, তিন সারির টিনের ঘরে ১২টি পরিবারের বসবাস। ১২ পরিবারের জন্য একটিই রান্নাঘর ও গোসল করার জায়গা। মাঝের সারির শেষ মাথার কক্ষে তিন হাজার ৭০০ টাকা ভাড়ায় নন্দন-লক্ষ্মী দম্পত্তি থাকতেন। তাদের কক্ষের সাথে লাগোয়া কক্ষে ডেকোরেশন কর্মী জামাল উদ্দিন থাকেন পরিবার নিয়ে। জামাল বললেন, ‘আমি এই বাসায় এক বছর আছি। নন্দন আসছে ছয় মাস হলো। কখনো স্বামী-স্ত্রীর তর্কও আমরা শুনিনি।’

সামনের কক্ষের শাহনাজ বেগম বললেন, ‘আমরা অনেক বছর শহরে। এমন ভদ্র স্বামী-স্ত্রী আমি খুব কমই দেখেছি।’

আরেক প্রতিবেশী মো. সুমন বলেন, ‘শুক্রবার নন্দন ও লক্ষ্মী তাদের শিশুকন্যাকে নিয়ে মন্দিরে পুজা দিয়ে এসেছে। পরিবারটা ধার্মিকও। সবার সাথে হাসি-খুশি ছিল। আমরা কেউ এমন একটা ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।’

রোববার দিবাগত রাত একটা পর্যন্ত কোন ক্লু না পেলেও পুলিশ চেষ্টা করছে নন্দনের এমন কোন ব্যাপার আছে কিনা যেটাতে লক্ষ্মী তার নাড়িছেঁড়া সন্তানসহ আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। কিংবা লক্ষ্মীর পরিবারের সদস্যদের কারো কাছে কোন তথ্য আছে কিনা সেটাও দেখছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে লক্ষ্মীর পরিবারের সদস্যরা সোমবার শহরে আসবেন বলে জানিয়েছেন তাদের এলাকার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। শ্রীরঞ্জন সরকার নন্দনের গ্রামের বাড়িও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!