মায়ের ঘাতক মাঈনু ছোট থেকেই বেপরোয়া, তাড়ানো হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া থেকেও

অর্থ ও সম্পত্তির লোভে নিজের মাকে গুলি করে হত্যা করা ছেলে মাঈনুদ্দীন ওরফে মাঈনু ছোটবেলা থেকেই উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করতেন। চট্টগ্রামের পটিয়ার প্রয়াত জাতীয় পার্টি নেতা সামশুল আলম মাস্টারের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। দুই ভাইয়ের মধ্যে মাঈনু বড়। তার ছোট ভাই মাশফিকুল আলম মাশফি বড় বোন শায়লা শারমিন নিপার সাথে থেকে অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করছেন।

যদিও ২০১৭ সালে মাঈনুকেও অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। মাত্র দুই বছর সেখানে থাকার পর তার ভিসা বাতিল করে অস্ট্রেলিয়া সরকার।

মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) দুপুরে মা জেসমিন আকতারকে (৫৫) গুলি করে হত্যা করেন বড় ছেলে মাঈনুদ্দীন ওরফে মাঈনু— যার বয়স এখন ২৯। বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পিস্তলটিও তিনি তার বাবার অফিস থেকে সংগ্রহ করেছিলেন।

মাঈনুর বাবা সামশুল আলম মাস্টার এরশাদ সরকারের শাসনামলে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ছিলেন। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ওই সময় তার বিরুদ্ধে অস্ত্রব্যবসারও অভিযোগ ছিল। শোনা যায়, জাপা সরকার ক্ষমতা হারানোর পর অবৈধ অস্ত্রগুলো তার অফিস ও বাড়িতে সংরক্ষিত ছিল। তবে এলাকায় তার জনপ্রিয়তা ছিল। পটিয়া পৌরসভার কর্ণধারও হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৩ ও ১৯৯৭ সালে সামশুল আলম মাস্টার পটিয়া পৌরসভার নির্বাচনে দুইবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

স্বজনদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ছোটকাল থেকেই বাবার অস্ত্র নিয়ে খেলা করতেন মাঈনু। বাবা সবসময় অস্ত্র নিয়েই চলাফেরা করতেন। পিতার হাতে অস্ত্র দেখে পুত্রের মধ্যেও অস্ত্র নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। বড় হওয়ার পর লেখাপড়ার পাশাপাশি মাঈনুল চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত হন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি আ জ ম নাছির গ্রুপের সঙ্গে থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে মাঈনু অস্ত্রধারী হিসেবে বিভিন্ন স্থানে ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী হিসেবে যেতেন। ২০২১ সালে ইউপি নির্বাচনে সাতকানিয়ার নলুয়া ইউপিতে অস্ত্রের মহড়া সৃষ্টি করেন তিনি। সেখানে গুলিতে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন।

২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পটিয়া পৌরসভা নির্বাচনের দিন বিভিন্ন কেন্দ্রে মাঈনুল অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেন। পৌরসভার ৮ নম্বর কেন্দ্রে মহড়া চালাতে গিয়ে কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুল মান্নানের ভাই আবদুল মাবুদ গুলিতে নিহত হন। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় বিজয়ী কাউন্সিলর সরওয়ার কামাল রাজীবকে আসামি করা হলেও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় মামলা থেকে বাদ পড়েন মাঈনু।

২০২১ সালের অক্টোবর মাসে পটিয়া ছনহরা ইউনিয়নে আলমদার পাড়া গ্রামে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মাঈনু নিরীহ লোকজনের ওপর গুলি চালান। এতে ৫ জন লোক গুলিবিদ্ধ হন। এ ব্যাপারে পটিয়া থানায় মাঈনুর বিরুদ্ধে মামলা হলেও পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান।

চট্টগ্রাম মহানগরী, পটিয়া, সাতকানিয়া থানাসহ বিভিন্ন থানায় মাঈনুর বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা রয়েছে। স্বজনরা বলছেন, পিতা-মাতা তাকে বাধা দেওয়া বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। এ কারণে মা জেসমিন আকতার বোন শাইলা শারমীন নিপা ও ভাই মাশফিকুল আলম মাশফি তার একমাত্র ভগ্নিপতির কাছে অস্ট্রেলিয়ায় থাকতেন। গত রমজানের ঈদের সময় তারা দেশে আসেন। এর মধ্যে ১৩ জুলাই তার পিতা সামশুল আলম মাস্টারের মৃত্যু হয়।

পিতার মৃত্যুর পর উচ্ছৃঙ্খল মাঈনু আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। ব্যাংকে তার পিতার রেখে যাওয়া টাকার নমিনি ছিলেন মা ও বোন। সেই টাকা তোলার জন্য গত মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) ব্যাংকে যান তারা। ব্যাংকের পরামর্শে এনআইডি কার্ড ও ছবি আনার জন্য পৌরসভার ঈদুল মল্ল পাড়া এলাকায় তাদের নিজ ঘরে গেলে বড় ছেলে মাঈনুল সব টাকা তাকে দেওয়ার জন্য চাপ দেন মাকে। দুপুরে এ নিয়ে মা-ছেলের সাথে তর্কাতর্কি হয়।

এই তর্কাতর্কির একপর্যায়ে মাঈনু প্রথমে বড় বোন নিপাকে গুলি করেন। এ সময় ভাগ্যক্রমে গুলিটি বিস্ফোরণ না হওয়ায় নিপা প্রাণে বেঁচে যান। এ সময় তার মা জেসমিন আকতার এগিয়ে আসলে তাকে গুলি করেন মাঈনু। রিভলবারের সেই গুলি এসে মা জেসমিনের ডান চোখের নিচে লাগলে সাথে সাথে তিনি লুটিয়ে পড়েন দ্বিতল ঘরের ফ্লোরে। আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে প্রথমে পটিয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতাল নিয়ে গেলেও অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। ওইদিন দুপুর তিনটার পর তাকে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

এ ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে বড় বোন শায়লা শারমীন নিপা বাদী হয়ে মাঈনুকে একমাত্র আসামি করে পটিয়া থানায় একটি হত্যামামলা দায়ের করেন।

র‌্যাব জানিয়েছে, মাকে গুলি করে দ্রুত চন্দনাইশের দোহাজারীতে চলে যান মাঈনু। সেখান থেকে পরিচিত এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে সাতকানিয়ায় গিয়ে একটি কারখানায় আশ্রয় নেন। এ সময় তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে মোবাইল ফোন সেট ফেলে দেন। এরপর ঢাকায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বুধবার সাতকানিয়ার কেরানিহাট থেকে তিনি ঢাকাগামী বাসে ওঠেন। ওই বাস শাহ আমানত সেতু এলাকায় পৌঁছার পর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে নিয়ে অভিযানে গিয়ে সাতকানিয়া এলাকার একটি গুদাম থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পিস্তলটি উদ্ধার করা হয়।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!