মাশরাফির কাছে ‘এই পৃথিবী অনেক নিষ্ঠুর’!

বাংলাদেশ ক্রিকেটের অবিসংবাদিত একজন মাশরাফি বিন মর্তুজা। যিনি জাতীয় দলের হয়ে অভিষেকের পর থেকে নিজেকে ধীরে ধীরে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়। অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়ার পর যেটি রূপ নেয় বটবৃক্ষের মতো। জাতীয় দলের নেতা হওয়ার পর থেকে সতীর্থদের সবসময় আগলে রেখে আসছেন। কখনো জনসম্মুখে নিজের হতাশা ব্যক্ত করেন না তিনি। এভাবেই পার করে এসেছেন ক্রিকেট জীবনের ১৮ বছর। সব ফরম্যাট মিলিয়ে ক্যারিয়ারের ৩০৭টি ম্যাচ। চারটি বিশ্বকাপ খেলা। অধিনায়কত্ব করা ৮৫ ম্যাচ পরে এসে ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজার কাছে মনে হচ্ছে- ‘এই পৃথিবী অনেক নিষ্ঠুর’!

নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে এমন মন্তব্য লিখেন মাশরাফি। বিশ্বকাপ শেষে মনের ভেতরে জমে থাকা দুঃখ-বেদনার স্পষ্টত পরিস্ফুটন ওয়ানডে অধিনায়কের এই চার শব্দের স্ট্যাটাসে! দুঃখটা কেবল আমারই থাক। আনন্দ হোক সবার- সারাজীবন এই পথে হেঁটে চলা মাশরাফির ফেসবুকে এই স্ট্যাটাস দেওয়ার পরই মনে হলো ভুল বাঁকে উঠে পড়ল জীবন গাড়ি। আর তাই আধঘণ্টার মধ্যেই নিজের লেখা সেই স্ট্যাটাস মুছে ফেলেন তিনি।

তবে ততক্ষণে নেটিং দুনিয়ায় ছড়িয়ে গেছে অধিনায়কের ‘ক্রিকেট দুঃখ’! মাত্র মাস দুয়েকের ব্যবধানে কি অদ্ভুতভাবেই না বদলে গেছে মাশরাফির ক্রিকেট জীবন। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছে-‘তুমি কবে যাচ্ছ?’ অথচ মে মাসে মাশরাফি যখন বিশ্বকাপে খেলতে যান তখন সেকি আয়োজন! সেকি স্বপ্নের ছড়াছড়ি! বাংলাদেশ বিশ্বকাপের শেষ চারে খেলবে বলে স্বপ্ন ঘুড়ির উড়াউড়ি। মাশরাফি নিজেই জানিয়ে যান- এটাই তার শেষ বিশ্বকাপ। কিন্তু সেই বিশ্বকাপের মাঝেই তাকে শুনতে হলো- তা তুমি ক্রিকেট ছাড়ছ কবে?

আর এখন বিসিবি কার্যালয়ে তাকে ডেকে নিয়ে বলা হচ্ছে-‘তুমি চাইলে যেতে পার!’

বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবী ব্যক্তিত্ব। একটা ভেঙেচুরে পড়া দলকে অসম্ভব মানসিক শক্তির জোরে টেনে তুলে বিশ্ব পরিমণ্ডলে প্রতিযোগিতামূলক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব তার। একজন তরুণ খেলোয়াড়ের সেরা পারফরমেন্স বের করে আনা, তার মধ্যে ম্যাচ উইনারের সুদৃঢ় ইচ্ছে শক্তি ছড়িয়ে দেওয়া, পুরো দলকে শক্তিমানের বিপক্ষে লড়াইয়ে জেতার জন্য উদ্দীপ্ত করা, দেশের হয়ে খেলে কিছু একটা করতে পারার মধ্যে যে অনিন্দ্য আনন্দ আছে অমন তাড়না তাগিদ তৈরি করা, অধিনায়ক মাশরাফির ‘আমরা করবো জয়ের’ সেই উদাত্ত আহ্বানই আমূল বদলে দিয়েছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটকে।

সেই কীর্তিমানকে আজ শুনতে হচ্ছে-আচ্ছা, আপনার বিদায় মানপত্রের ছত্রক আপনি নিজেই লিখে দিন! ঠিক কেন এমন বিয়োগান্তক পরিস্থিতির তৈরি হলো যে, আজ মাশরাফিকে লিখতে হচ্ছে-‘পৃথিবীটা অনেক বেশি নিষ্ঠুর’!

শুধু ক্রিকেটারদের মধ্যে নয়, সাংবাদিক মহলেও অধিনায়ক মাশরাফি খুবই জনপ্রিয়। বন্ধু বৎসল। সেই ‘পরিচিত মহল’ থেকেও মাশরাফি দেখছেন পিঠে ছুরি মারতে উদ্যত অনেক পরিচিতকে। অধিনায়কের ‘অফ দ্য রেকর্ডকে’ কেউ যখন ‘অন দ্য রেকর্ড’ করে দেন ‘ব্রেকিং নিউজের’ লোভে, তখন তার আহত বোধ করাই স্বাভাবিক। বিশ্বাসের অমর্যাদা সব মানুষকেই আহত করে। অধিনায়কের কাছে তাই এখন তার ক্রিকেট পৃথিবী অনেক বেশি নিষ্ঠুর!

মাশরাফির কাছে ‘এই পৃথিবী অনেক নিষ্ঠুর’! 1
মাশরাফির কাছে মনে হচ্ছে- ‘এই পৃথিবী অনেক নিষ্ঠুর’

বিশ্বকাপ শেষে কোনো একসময় মাশরাফি ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়াবেন সেটা প্রায় অনুমিত ছিল। কিন্তু কবে দাঁড়াবেন সেই সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা তিনি দেননি। সেটা নিয়ে যে বিসিবি কর্তাদেরও খুব একটা মাথা ব্যাথা ছিল তা নয়। কারণ এই বিসিবির প্রধান তো নিজেই একসময় বলেছিলেন-‘মাশরাফি কখন ক্রিকেট ছাড়বে, সেটা তার বিষয়। তার সিদ্ধান্ত।’

তবে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচটা অধিনায়কের সঙ্গে বিসিবির প্রেমময় সম্পর্কে একটা বিচ্ছেদ ঘটায়। লর্ডসে পাকিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচটায় মাশরাফি খেলছেন না- সেটা স্থির হয়। তেমন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন খোদ বিসিবি বস। কিন্তু পরদিন মাশরাফি নেমে পড়লেন টস করতে।

অধিনায়ক ম্যাচে খেলবেন কিনা- সেটা তো অধিনায়কই স্থির করবেন। কিন্তু বাংলাদেশ হলো ক্রিকেট বিশ্বের তেমনই এক দেশ যেখানে বোর্ড সভাপতিই একাদশ গঠনে ‘প্রধানতম নির্বাচক’! বর্তমান সভাপতি এবং ঠিক তার আগের সভাপতি-দুজনেই এই ‘অযাচিত অতিরিক্ত ক্ষমতা’ ব্যবহার করেছেন।

লর্ডসে মাশরাফির একাদশে খেলা যে বিসিবি সভাপতির পছন্দ হয়নি, সেটা তিনি দেশে ফিরে সাফ জানিয়েও দিলেন। কোচ স্টিভ রোডস যে চাকরি হারালেন তার অন্যতম কারণও লর্ডসের একাদশ গঠনে সভাপতির সিদ্ধান্ত না মানা। আর অধিনায়ক মাশরাফিকে মুলত সেদিনই থেকেই বিসিবি বাংলাদেশ ক্রিকেটে ‘মাইনাস’ ভাবতে শুরু করে। ‘নিষ্ঠুরতার’ সঙ্গে মাশরাফির প্রাথমিক পরিচয়ও সেদিন থেকেই।

তবে ২২ গজে এতদিন ক্রিকেট লড়াই জেতা মাশরাফির সামনের সময়ের পৃথিবী যে এখন আরো অনেক অনেক বড়ো-একেবারে ৫৬ হাজার বর্গমাইল। এখন তো তার সামনে আরো অনেক বেশি দুঃখী মানুষকে আনন্দিত করার সুযোগ। সমস্যা হলো, ক্রিকেটের চেয়ে ‘রাজনীতির উইকেট’ যে আরো বেশি নিষ্ঠুর, আরো বেশি বিষময়!

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!