মালিক কারামুক্ত, ৪ বছর ধরে ঘোড়াগুলো বন্দি চিড়িয়াখানায়

বনে-জঙ্গলে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবাধ বিচরণ করে কাটানোর কথা মুক্তজীবন। কিন্তু মালিকের ‘শখের’ খেসারত দিচ্ছেন অবলা দুটি প্রাণী। অবরুদ্ধ হয়ে আছে তাদের স্বাভাবিক জীবন। মাত্র চার হাজার বর্গফুটের ইট-লোহার খাঁচায় বন্দি দুই ঘোড়া। এটিই এখন তাদের স্থায়ী ঠিকানা! লোকালয়েই কাটছে তাদের অস্বাভাবিক জীবন। খাঁচাবন্দি থেকে এখন হাজার হাজার দর্শনার্থী মানুষের উপভোগ্য হয়ে উঠেছেন প্রাণী দুটি।

সাড়ে চার বছর ধরে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় বন্দি রয়েছে ঘোড়াগুলো। যদিও ঘোড়ার মালিক বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও ঘোড়া দুটি খাঁচাবন্দিই রয়ে গেছে। রাঙামাটি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নির্দেশে দৃষ্টিনন্দন ঘোড়া দুটি চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার জিম্মায় রয়েছে।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার কিউরেটর ও পশু চিকিৎসক শাহাদাৎ হোসেন শুভ জানান, ২০১৫ সালে রাঙ্গামাটি আদালত থেকে চিড়িয়াখানার জিম্মায় দেওয়ার পর থেকে আমরা খুবই যত্ন করে ঘোড়া দুটির দেখাশোনা করছি। প্রতিদিন দুটি ঘোড়ার খাবারের পেছনে আমরা ৮০০ টাকা করে ব্যয় করছি। চিড়িয়াখানার অন্য পশুপাখির মতো ঘোড়াগুলোকেও চারদিকে ইটের দেওয়ালে ঘেরা নিদিষ্ট স্থানে রাখা হয়েছে। দর্শনার্থীদের টিকেটের অর্থ দিয়েই অন্য পশুপাখির মতো ঘোড়াগুলোর যাবতীয় ব্যয় মেটানো হচ্ছে।

নৌকায় সেই দুটি ঘোড়া নিয়ে কাপ্তাই লেক পার হচ্ছেন ডা. রেনিন সো।
নৌকায় সেই দুটি ঘোড়া নিয়ে কাপ্তাই লেক পার হচ্ছেন ডা. রেনিন সো।

সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার পেছনের অংশে পাহাড়ের ঢালুতে প্রায় চার হাজার বর্গফুটের জায়গায় হাঁটাহাটি করছে ঘোড়া দুটি। চারদিকে তিন থেকে চার ফুট ইটের দেয়াল দিয়ে খাঁচাবন্দি করে রাখা রয়েছে। বেশ কয়েকজন দর্শনার্থী ঘোড়াগুলোর সঙ্গে খেলা করছিলেন। এর মধ্যে নগরীর বায়েজিদের শেরশাহ কলোনি থেকে পরিবারের সঙ্গে আসা ১৪ বছরের সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘এই প্রথম সরাসরি ঘোড়া দেখলাম। খুবই সুন্দর লাগছে ঘোড়াগুলো। ঘোড়ার লেজ ও ঘাড়ের অংশটি বেশি সুন্দর লেগেছে।’

চিড়িয়াখানার কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত বুনো ঘোড়া বনে জন্মায়, বনেই বাস করে। পর্তুগাল, স্কটল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড এবং উত্তর আমেরিকার আটলান্টিক উপকূল ও জর্জিয়ার উপকূলে এদের বেশি দেখা যায়। ঘোড়াগুলোর আকার জাতের উপর নির্ভর করলেও এদের ওজন ৩৫০ থেকে এক হাজার কেজি বা তারও বেশি হতে পারে। এ ঘোড়া প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ কেজি ঘাস, শসা, গাজর, ভুসি ও মটর কলাই খেয়ে থাকে। ৩৪০ দিনে একবার একটি শাবক জন্ম দেয়। শাবক জন্মের অল্প সময়ের মধ্যে চলাফেরায় সক্ষম হয়ে ওঠে। বাচ্চা সাধারণত ৪ থেকে ৬ মাস বয়েসের মধ্যে তাদের মা থেকে আলাদা হয়ে যায়। এ ঘোড়ার আয়ুস্কাল ২০ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে।

আদালত ও চিড়িয়াখানা সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলীতে একটি বহুতল বাড়ি করেন আরাকান আর্মি চিফের উপদেষ্টা ডা. রেনিন সো। ২০১৪ সালে রাজস্থলীর তাইতংপাড়ার বাড়িটির নির্মাণ শেষ হয়। বাড়ি নির্মাণ করার পর থেকে আরাকান আর্মির সদস্যদের রাজস্থলীর তার বাড়িতে আসা-যাওয়া বেড়ে যায়। আহত আরাকান আর্মির সদস্যদের তার বাড়িতেই দেওয়া হতো চিকিৎসাসেবা। এসব অভিযোগ পেয়ে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট রেনিনের বাড়ি অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। তার বাড়ি থেকে আরাকান আর্মির পোশাক, অস্ত্র-গোলাবারুদ ছাড়াও দুটি ঘোড়া উদ্ধার করে যৌথবাহিনী।

মালিক কারামুক্ত, ৪ বছর ধরে ঘোড়াগুলো বন্দি চিড়িয়াখানায় 1

এ ঘটনায় ২০১৫ সালের ২৬ আগস্ট রাঙ্গামাটির রাজস্থলী থানা পুলিশ বাদি হয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং বিদেশী নাগরিক সম্পর্কিত আইনে দুটি মামলা দায়ের করে। দুটি মামলায় ৩০টি আলামত জব্দ করা হয়। এর মধ্যে ১৮ নম্বর আলামত হচ্ছে দুটি ধুসর বর্ণের ঘোড়া। মামলা দায়েরের পর আলামতগুলো রাঙ্গামাটি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থাপন করা হলে ঘোড়া দুটি চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার জিম্মায় দেওয়ার নির্দেশ দেন বিচারক।

সেই থেকে ঘোড়া দুটি চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় খাঁচাবন্দি রয়েছে। এর মধ্যে ঘোড়া দুটির মালিক ডা. রেনিন সো ২০১৫ সালের ১৪ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন। ২০১৭ সালের ৫ জুন রাঙ্গামাটি জেলা কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান তিনি। কিন্তু নিজে মুক্তির স্বাদ নিলেও এখনো ঘোড়া দুটি মুক্ত কিংবা জিম্মায় নেওয়ার কোন আগ্রহ দেখাননি রেনিন।

প্রসঙ্গত, ডা. রেনিন সো ১৯৬৯ সালে মিয়ানমারের তামাই কোয়ার্টার রেঙ্গুনে জন্মগ্রহণ করলেও ১৯৯৮ সালের ৩০ জুন রাজস্থলীর তাইতংপাড়ার হ্লাচিংনু মার্মাকে বিয়ে করে রাজস্থলীতে স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন। তিনি একই সঙ্গে নেদারল্যান্ডেরও নাগরিক।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!