মারা গেলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ

মারা গেলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। গত ১০ দিন ধরে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) লাইফ সাপোর্টে ছিলেন তিনি। চিকিৎসকরা রোববার সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে আনুষ্ঠানিকভাবে তার মৃত্যুর ঘোষণা দেন।

৯০ বছর বয়সী এরশাদ রক্তের ক্যান্সার মাইডোলিসপ্লাস্টিক সিনড্রোমে আক্রান্ত ছিলেন। শেষ দিকে তার ফুসফুসে দেখা দিয়েছিল সংক্রমণ, কিডনিও কাজ করছিল না। এরশাদের কোনো অঙ্গই আর স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে না।

ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) জীবনের শেষ ছবিতে স্ত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে।
ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) জীবনের শেষ ছবিতে স্ত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে।

গত কয়েক বছর ধরেই স্বাস্থ্য নিয়ে সমস্যায় ছিলেন এরশাদ। গত বছরের শেষ ভাগে সিঙ্গাপুরে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আসার পর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে খুব একটা দেখা যায়নি তাকে। এই সময়ে নিজের সম্পত্তি ট্রাস্টে দিয়ে যান তিনি। গত ২২ জুন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় এরশাদকে সিএমএইচে নেওয়া হলে রাখা হয় ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে। অবস্থার অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। পরে নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত-সমালোচিত চরিত্র এরশাদ সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় আশির দশকে অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে আট বছর দেশ শাসন করে গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের আগের সরকারে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্বপালনকারী এরশাদ বর্তমান সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্বে ছিলেন।

অসুস্থতার কারণে ভাই জি এম কাদেরকে উত্তরসূরি ঘোষণা করে তাকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও বসিয়ে যান এরশাদ; যা নিয়ে দলের জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান রওশনের সমর্থকরা রুষ্ট ছিলেন বলে জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ

চার জানাজা
রোববার বেলা ১টা ৫০ মিনিটে ঢাকা সেনানিবাসে সেনা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে এরশাদের প্রথম জানাজা হয়। এতে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, সাবেক সেনাপ্রধান আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক, সাবেক সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহবুবুর রহমান, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম, এরশাদের ভাই ও জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের, মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা, এরশাদের বড় ছেলে সাদ এরশাদসহ উপস্থিত ছিলেন।

এরশাদের মরদেহ এখন সিএমএইচের হিমঘরে রাখা হবে।

সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় বিরোধী দলীয় নেতার দ্বিতীয় জানাজা হবে। নেতা-কর্মীসহ সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের মরদেহ বেলা ১২টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত কাকরাইলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রাখা হবে। একই দিন বাদ আছর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে তৃতীয় জানাজার পর এরশাদের মরদেহ আবারও সিএমএইচের হিমঘরে রাখা হবে।

বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে সাবেক এই রাষ্ট্রপতির মরদেহ মঙ্গলবার সকালে রংপুরে নেওয়া হবে। সকাল সাড়ে ১০টায় জেলা শহরের ঈদগাহ মাঠে ‘পেয়ারা’ নামে পরিচিত রংপুরের সন্তান এরশাদের চতুর্থ জানাজা হবে।

হেলিকপ্টারে করে ঢাকার আনার পর ওই দিনই বাদ জোহর বাংলাদেশের চতুর্থ সেনাপ্রধানের মরদেহ সেনা কবরস্থানে দাফন করা হবে। পরদিন বুধবার বাদ আছর গুলশানের আযাদ মসজিদে এরশাদের কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে।

জীবনবৃত্তান্ত
১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত ভারতের কোচবিহার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এরশাদ। পরে তাঁর পরিবার রংপুরে চলে আসে। রংপুরেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন এরশাদ। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে ১৯৭১-৭২ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তন করেন।

১৯৭৩ সালে এরশাদকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ওই বছরই আগস্ট মাসে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাঁকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদকে সেনাবাহিনীপ্রধান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭৯ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের অব্যবহিত পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (সিএমএলএ) হিসেবে দেশ শাসন করেন। এরপর রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এরশাদ। স্বৈরাচারবিরোধী প্রবল গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

১৯৯১ সালে জেনারেল এরশাদ গ্রেপ্তার হন। তাঁকে কারাবন্দী করে রাখা হয়। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে জেলে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় এরশাদ রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও এরশাদ সংসদে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হন। ছয় বছর জেলে থাকার পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের আমলে তিনি জামিনে মুক্ত হন।

২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি ১৪টি আসনে জয়ী হয়। এরপর ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের সঙ্গে মহাজোট গঠন করেন তিনি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর দল ২৭টি আসনে বিজয়ী হয়। এরপর দশম ও সবশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি সাংসদ হন। তিনি চলতি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন।

রাষ্ট্রপতির শোক
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রচার কার্যক্রমের সমাপনী অনুষ্ঠানে এইচ
সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতি এক শোকবার্তায় এরশাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

শেখ হাসিনার শোক
সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, “জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ- এর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা এক শোকবার্তায় বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে সংসদে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের গঠনমূলক ভূমিকার কথা স্মরণ করেন।”

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!