মাঠ নেই— শহর চট্টগ্রাম মুখ ফেরাচ্ছে খেলা থেকে, কিশোররা ঝুঁকছে গ্যাং ও মাদকে

দেশের ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ খ্যাত চট্টগ্রাম নগরীতে প্রায় ৮০ লাখ মানুষের বসবাস। কিন্তু শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠের অভাব এই নগরীতে। গত এক দশকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক মাঠ। আবার অনেক মাঠের জায়গায় গড়ে উঠেছে স্থাপনা। ফলে এ প্রজন্মের শিশু-কিশোরদের মাঠে খেলার চেয়ে সময় বেশি কাটছে মোবাইল গেমে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে জীবনযাত্রায়ও। অনেকে অল্প বয়সে মাদক সেবন করছে, আবার অনেকে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে।

মাঠ নেই— শহর চট্টগ্রাম মুখ ফেরাচ্ছে খেলা থেকে, কিশোররা ঝুঁকছে গ্যাং ও মাদকে 1

মাঠ না থাকায় বেশিরভাগ সময় শিশু-কিশোরদের ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হয়। ফলে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে তারা। এর প্রভাবে অল্প বয়সে ভার্চুয়াল জগৎ, অনলাইন জুয়া ও পর্নোগ্রাফির মতো মারাত্মক নেশায়ও জড়িয়ে পড়ছে তারা।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে খেলার মাঠের সংখ্যা হাতেগোণা। এখন কোনো ধরনের প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট বা খেলার আসর আয়োজনও হয় না।

এছাড়া নগরীর যেসব কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে সেগুলোতে নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ। প্রায় স্কুল গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ভবনের বদ্ধ রুমে। ফলে শিশুদের খেলাধুলার বিকাশে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, পতেঙ্গার কর্ণফুলীর তীরে জেগে ওঠা চরের জায়গায় আগে শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করতো। কিন্তু এখন সেখানে কন্টেইনার ডিপো করা হয়েছে। পতেঙ্গা ১১ নম্বর এলাকায় রাস্তার সামনে বিশাল একটি মাঠ ছিল। সেটি এখন চিটাগাং বোট ক্লাবের। এছাড়া হাউজিং কলোনির মাঠে র্যারব-৭ এর সদরদপ্তর গড়ে ওঠার পর থেকে সেখানেও খেলাধুলা বন্ধ।

ইপিজেডে লেবার কলোনির মাঠ ও নেভী হল সংলগ্ন মাঠগুলো রয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষের আওতায়। বন্দরের আনন্দবাজার এলাকায় সাগরপাড়ে যেখানে শিশুরা ফুটবল-ক্রিকেট খেলতো সেখানে বে-টার্মিনাল হচ্ছে। ডাবলমুরিংয়ের আগ্রাবাদ জাম্বুরি মাঠ এখন শিশুপার্ক। কোতোয়ালীর কাজির দেউড়ি আউটার স্টেডিয়াম মাঠের অর্ধেক অংশে সুইমিংপুল। বাকি অংশে বিভিন্ন সময় মেলার আয়োজন, গাড়ি পার্কিংসহ নানা কারণে খেলাধুলা করা যায় না। এছাড়া এই জায়গায় গড়ে উঠেছে মাদকসেবীদের আখড়া।

ঘাটফরহাদবেগ বুড়িমার মাঠে এখন জনবসতি। লালদীঘির মাঠ আধুনিকায়নের কারণে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। পাহাড়তলী পাঞ্জাবি লেন কালী বাড়ির মাঠ এখন হয়ে গেছে রাস্তা। খুলশীর মাস্টার লেন সৃজনী মাঠও খেলাধুলার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে।

এছাড়া চকবাজারের চট্টগ্রাম কলেজ মাঠ (প্যারেড মাঠ), মহসিন কলেজ মাঠ চারদিকে লোহার গ্রিলের বাউন্ডারি দেওয়া। এর ফলে শিশু-কিশোররা ঝুঁকি নিয়ে লোহার গ্রিল টপকে মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করে। পতেঙ্গা বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠ, হাউজিং কলোনির মাঠ-২, সিমেন্ট কলোনির মাঠ, পদ্মা অয়েল কোম্পানির মাঠ, এয়ারপোর্ট স্কুলের মাঠ, হাজী ক্যাম্পে মাঠে আগের মতো ছেলেদের দেখা যায় না খেলাধুলা করতে।

বেপজা কলেজের মাহিম নামের দ্বাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের এলাকায় তেমন খেলার মাঠ নেই, আমরা খেলবো কোথায়? আমার বাবা রাজমিস্ত্রি আর মা গৃহিণী। তাদের সামর্থ নেই আমাকে খেলা শেখাতে বিভিন্ন একাডেমিতে ভর্তি করানোর।’

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের গত ৫ থেকে ১০ বছরে অনেক ক্ষতি হয়েছে ক্রীড়াঙ্গনের। তেমন কোনো প্রতিভাবান মেধাবী খেলোয়াড় তৈরি হয়নি। এখন আর আগের মত খেলার মাঠ নেই, খেলোয়াড়ও নেই।’

তিনি বলেন, ‘একটা সময় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা বার্ষিক পরীক্ষা শেষে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার জন্য মাঠে যেতো। এখন মাঠ নেই, ওরা খেলবে কোথায়? বর্তমান প্রজন্ম খেলাধুলার চেয়েও মোবাইলে আসক্ত বেশি। ফলে সমাজে বাড়ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। যারা খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত তারা মাদক ও সন্ত্রাস থেকে দূরে থাকে।’

নিজের খেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আকরাম খান বলেন, ‘আমাদের সময়ে আমরা আউটার স্টেডিয়াম, পলোগ্রাউন্ড, প্যারেড মাঠ, জিয়া পার্ক ও রেডিসন ব্লুর পেছনের মাঠে খেলতাম। বর্তমানে অধিকাংশ মাঠই বিলুপ্ত।’

পতেঙ্গা ফরিদ ফুটবল একাডেমির প্রশিক্ষক ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘পর্যাপ্ত মাঠ না থাকার কারণে আমরা খেলোয়াড়দের ঠিকমতো অনুশীলন করাতে পারি না। আর এ কারণে একাডেমিতে এসে শিখতে ছেলেমেয়েরা আগ্রহ দেখায় না।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্রের ইনচার্জ প্রমুগ্ধা হাফিজ বলেন, ‘খেলাধুলা শিশুদের মেধা বিকাশে সহায়তা করে। খেলার মাঠ না থাকলে সেই বিকাশ ব্যাহত হয়। খেলার মাঠে সবার সোনালী শৈশব ও কৈশোর মিশে থাকে। খেলাধুলা মানবদেহকে সক্রিয় করে, শরীর ও মনকে প্রশান্ত রাখে। অতিমাত্রায় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের ফলে শিশুদের মস্তিষ্কে টিউমার ও নিদ্রাহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এর পাশাপাশি দৃষ্টিশক্তির ওপর এর প্রভাব দেখা দিতে পারে।’

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ ও পার্কসহ বিভিন্ন প্রস্তাবনা আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। ইতোমধ্যে ৪, ৬, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে আমরা খেলার মাঠ করার পরিকল্পনা নিয়েছি। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনে বিভিন্ন ওয়ার্ডে সিটি কর্পোরেশনের বেদখল জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।’

এ বিষয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরজুড়ে প্রয়োজনের তুলনায় মাঠ কম। ইতোমধ্যে লালদীঘির মাঠ উন্নত করা হয়েছে, যা শীঘ্রই উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। অন্যদিকে বাকলিয়া এলাকায়ও একটি মাঠ তৈরি করা হচ্ছে। তবে নগরীর প্রত্যেক এলাকায় খেলার মাঠ তৈরি করার পরিকল্পনা আছে।’

ডিজে/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!