মহালয়ায় শুরু দুর্গোৎসব, চট্টগ্রামে এবার ২১০৪ মণ্ডপ

শরতের মিঠেল রোদ, আকাশে পেঁজা তুলো, শুভ্র শিউলির ভোরের উঠোনে ঝরে পড়া শিশির আর নদীর ধারে মাঠে মাঠে কাশের সমারোহ— এ সবকিছুই জানান দিচ্ছে ‘দেবী মা’ আসছেন। থেমে থেমে শরতের আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামলে যেন আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে একটা পুজো পুজো গন্ধ। সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালির পূজা তো সেইদিন থেকে শুরু হয়, যেদিন থেকে শুরু হয় পুজোর জন্য অপেক্ষা। দেবী মায়ের আগমনে ঢাক আর শঙ্খ ধ্বনির তালে মেতে উঠার অপেক্ষা যেন শেষের পথে সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষদের। পূজার ঘন্টা ধ্বনি কড়া নাড়ছে সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালিদের দরজায়।

হিন্দু পুরাণ মতে, আশ্বিন মাসের শুক্লাপক্ষে শারদীয়া এবং চৈত্র মাসের শুক্লা পক্ষে বাসন্তি দুর্গাপূজার সময় গণনা করা হতো। আগেকার সময়ে বসন্তকালে জলবসন্ত রোগের প্রকোপ দেখা দিলে রোগ-শোক, অভাব দেখা দিত। সনাতন ধর্ম মতে, যা কিছু দুঃখ-শোক, জ্বালা-যন্ত্রণা এসব থেকে ভক্তকে রক্ষা করেন দেবী দুর্গা। দেবী দুঃখ দিয়ে মানুষের সহ্য ক্ষমতা পরীক্ষা করেন। তখন মানুষ অস্থির না হয়ে তাকে ডাকলেই তিনি তার কষ্ট দূর করেন। ফলে তখন থেকেই বাসন্তী পুজো অপেক্ষা শরৎকালের দুর্গোৎসব কালক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠে।

আর সেই থেকে অকালবোধন হওয়া সত্ত্বেও শরৎকালেই দুর্গাপূজা প্রচলন হয়ে যায়। পঞ্জিকামতে এবার দেবীর মর্ত্যে আগমন ও গমন দুই-ই ঘোড়ায় চড়ে। দেবী দুর্গার বাহন সিংহ, কিন্তু পঞ্জিকা মেনে মর্ত্যে আগমন ও বিদায়ের জন্য প্রতিবার পৃথক পৃথক বাহন বেছে নেন দুর্গা। কখনোও ঘোড়া, কখনও হাতি, কখনও দোলা আবার কখনও নৌকায় আসা-যাওয়ার পর্ব সারেন দেবী। শাস্ত্রমতে দেবীর ঘোড়ায় আসা বা যাওয়া কোনওটাই শুভ লক্ষণ বলে বিবেচিত নয়।

ঘোড়ায় দেবীর আগমনের অর্থ ছত্রভঙ্গ পরিস্থিতি। আবার পূজা শেষে মর্ত্য থেকে বিদায় নেওয়ার সময়ও সবকিছু ছারখার হয়ে যাবে। এতে সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঘোড়ায় আগমন ও গমনের ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা। তবে যেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক না কেন দেবী দুর্গা কখনও ভক্তদের নিরাশ করেন না—এমনটাই বিশ্বাস সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষদের। তাই সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজার জন্য অপেক্ষায় সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

মহানগর ও উপজেলায় এবার সার্বজনীন ও পারিবারিক পূজা মণ্ডপসহ মোট ২ হাজার ১০৪টি মণ্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়েছে। নগরীতে পূজার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ২৭২টি মণ্ডপ এবং উপজেলায় ১ হাজার ৮৩২টি পূজামণ্ডপ। মণ্ডপগুলোতে নেওয়া হচ্ছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা। নগরীতে সবচেয়ে বেশি পূজামণ্ডপ কোতোয়ালী থানা এলাকায়। জেলার মধ্যে উপজেলাভিত্তিক সর্বাধিক পূজামণ্ডপ রাউজানে। সবচেয়ে কম নগরীর বাকলিয়া থানায় এবং সন্দ্বীপে।

শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) থেকে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মহালয়ার মধ্যে দিয়ে দুর্গাপূজার দিনক্ষণ শুরু হল। এরপর ৩ অক্টোবর গোধূলিলগ্নে দেবীর বোধন, ৪ অক্টোবর সকালে ষষ্ঠীপূজার মাধ্যমে শুরু হবে মূল আয়োজন। এদিন গোধূলিলগ্নে দেবীর আগমন ঘটবে। মহাসপ্তমীতে সকাল থেকে পূজা চলবে, এছাড়া দুর্গা দেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপনও করা হবে। এদিন দুস্থদের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ করা হয়। মহাষ্টমীতে কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজা, দুপুরে সন্ধিপূজা এবং বিকালে মহাপ্রসাদ বিতরণ হবে। নবমীতে সকাল থেকে পূজা চলবে, সন্ধ্যায় আরতি প্রতিযোগিতা হবে। বিজয়া দশমীর দিন সকাল থেকেই পূজা হবে এবং বিকালে হবে প্রতিমা বিসর্জন।

এদিকে দুর্গাপূজাকে ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে মণ্ডপে মণ্ডপে। চট্টগ্রাম নগরীর জেমসেন লেন হল, গোসাইল ডাঙা, সিটি করপোরেশনের কুসুম কুমারী মন্ডপ, হাজারী গলি, চট্টেশ্বরী কালী মন্দির, চেরাগি পাহাড়সহ সব পূজা মণ্ডপগুলোতে কাজ চলছে পুরোদমে। ইতোমধ্যে অনেক জায়গায় আলোকসজ্জার পাশাপাশি মণ্ডপের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে।

চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শ্রী প্রকাশ দাশ অসিত চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন,’ আমাদের প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। দেবী এবার ঘটকেই আসবেন এবং ঘটকেই যাবেন। আজকে থেকে মহালয়া। ৩ তারিখ থেকেই আমাদের পূজা অর্চনা শুরু। ইতিমধ্যে সম্প্রীতি সমাবেশ হয়েছে। সেখানে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে দুর্গাপূজা সম্পন্ন করতে নগরীর স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সব ধর্মের প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়েছে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘দুর্গাপূজা নিয়ে প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। সামগ্রিক বিষয় নিয়ে সম্প্রীতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধে উঠে উৎসবমুখর পরিবেশে দুর্গাপূজা সম্পন্ন করার বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।

চট্টেশ্বরী কালী মন্দিরের পূজার দায়িত্বে মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বিজয় চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে। আশা করি, পঞ্চমীর আগেই মণ্ডপ প্রস্তুত হয়ে যাবে। এরপর ৩ তারিখ থেকে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে।

নিরাপত্তা প্রসঙ্গে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন) আমেনা বেগম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের সকল থানার অফিসার ইনচার্জরা কমিটির প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে সম্প্রীতি কমিটি তৈরি করেছে। স্বেচ্ছাসেবকদের তালিকা আমরা পেয়ে গেছি। তারা সেখানে পাহারা দেবে। নিরাপত্তা বিষয়ে আমাদের মোবাইল টিম সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করছে। এছাড়া প্রয়োজনে পুলিশের কল সেন্টার ৯৯৯-এ ফোন করলে তাৎক্ষণিক আইনি সহায়তা পাওয়া যাবে।

তিনি আরও জানান, ‘দুর্গাপূজা উপলক্ষে যে কোনও প্রয়োজনে জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুমের নম্বর ০৩১-৬১১৫৮১ ও ০১৮৮০-০০২৪২৪-এ যোগাযোগ করা যাবে এবং প্রতিমা বিসর্জনের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।’

এসআর/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!