মশক ‘সন্ত্রাসে’ অতিষ্ট চট্টগ্রাম শহর, অকাজের ওষুধে টাকা ওড়ায় সিটি কর্পোরেশন

শীতেই ডেঙ্গু মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে— চিন্তিত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা

মশার উপদ্রবে দুর্বিসহ জীবন নগরবাসীর। শুধু রাতে নয়, সারাদিনই মশার উৎপাতে অতিষ্ট মানুষ। সর্বত্র মশার উপদ্রব সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেলেও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী তা মানতে নারাজ। মশা মরে না জেনেও কখনও কখনও অকার্যকর ওষুধ ছিটিয়ে দায় সারা হয়। অথচ এই শীতেও হঠাৎ করেই চট্টগ্রাম নগরীতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ডেঙ্গু রোগী। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদেরও বিষয়টি চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।

কিন্তু নির্বিকার সিটি মেয়র রেজাউলের দাবি, চট্টগ্রামে মশার উপদ্রব ‘স্বাভাবিক’। মেয়রের দাবির সাথে মহানগর এলাকার চিত্র একেবারেই ভিন্ন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, গত এক মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ২৭০ জন। যেখানে গত ১০ মাসেই ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৭৮। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৮ জন। ডেঙ্গু হঠাৎ এমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও এখনো মশা মারার কার্যকর ওষুধের হদিস পাননি চসিক।

সিটি মেয়র রেজাউল বলেন, ‘শীত মৌসুমে স্বাভাবিকভাবেই মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। মশার উপদ্রব কমাতে সিটি করপোরেশন খাল-নালা পরিষ্কার করছে, মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে। কোথাও যাতে পানি আটকে না থাকে, সেটা আমরা দেখছি। এছাড়া মশা নিধনে বিশেষজ্ঞ পরামর্শক দলের সুপারিশের ভিত্তিতে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে।’

তবে মেয়র নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানোর কথা বললেও মাঠপর্যায়ে এরকম তৎপরতা দেখা যায় না। নগরীর ২ নম্বর গেইট, ষোলশহর, বহদ্দারহাট, শুলকবহর, সদরঘাট, খাতুনগঞ্জ, আগ্রাবাদ ও পাহাড়তলীসহ একাধিক এলাকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নিয়মিত ময়লা অপসারণের কাজ হয়ে আসলেও নালা-নর্দমা পরিষ্কার ও মশকনিধন কার্যক্রম নিয়মিত হয় না।

শুলকবহর এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন এখানে ময়লাওয়ালা (চসিকের পরিচ্ছন্নকর্মী) এসে ময়লা নিয়ে যায়। কিন্তু নালা নর্দমা পরিষ্কার করতে ও মশার ওষুধ ছিটাতে গত একমাসে কাউকে দেখিনি।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ সরকারি উর্ধতন কর্মকর্তাদের বাসভবন এলাকায় তালিকা ধরে মশার ওষুধ ছিটানো হয়। এছাড়া চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে নগরীর বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক এলাকায় এ ওষুধ ছিটানোর ব্যবস্থা করা হয়। অথচ চট্টগ্রাম নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের আনাচকানাচে বিশেষ করে, মশার প্রজননস্থল বিভিন্ন নালা-নর্দমা ও জমে থাকা পানিতে চসিকের মশক নিধন কার্যক্রম নেই।

চুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহজালাল মিশুক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে শীতকালে ডেঙ্গু বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হতে পারে দুটি। প্রথমত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শীতকালে তুলনামূলক বেশি বৃষ্টি হওয়া। দ্বিতীয়ত ড্রেন কিংবা নালা (মশার উৎসগুলো) অপরিস্কার থাকা। বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ডেঙ্গু প্রতিরোধে চারটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার জড়িত। এক পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা, দুই মশার জৈবিক নিয়ন্ত্রণ, তিন কীটনাশক প্রয়োগ এবং ডেঙ্গু ঠেকাতে নাগরিকদের যুক্ত করা। এই ব্যাপারগুলো সঠিকভাবে নিশ্চিত করা না গেলে ডেঙ্গু প্রকোপ দূর করা অনেকাংশেই অসম্ভব।’

তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যকর ও পরিকল্পিত শহর হিসেবে বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে না পারলে ধীরে ধীরে ডেঙ্গুসহ অন্যান্য রোগ-বালাই নগরবাসীকে ধীরে ধীরে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে ফেলবে। তাই চট্টগ্রামের নগর উন্নয়নে টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং চলমান প্রকল্পগুলো অতিদ্রুত সফলভাবে শেষ করা। ড্রেনে জমে থাকা পানি নিঃসরণ ও নালা কিংবা ড্রেন পরিস্কার রাখাসহ নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানোর মাধ্যমে ডেঙ্গুসহ অন্যান্য রোগ থেকে নগরবাসীর মুক্তি মিলবে।’

এদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, সাধারণত বর্ষার সময় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। কিন্তু এ বছর শীতের শুরুতেও এর প্রভাব বেড়েছে। এটা আশঙ্কাজনক। ডেঙ্গু দমন করতে সবাইকে সচেতন হওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যায়। কিন্তু এবার শীতেও ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে— এটি চিন্তার বিষয়। কারও ডেঙ্গু শনাক্ত হলে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া ও তরল খাবার খাওয়াতে হবে।’

করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়েও বিশেষভাবে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি।

মশা দমনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চসিকের প্রতি আহবান জানিয়েছেন বিশিষ্ট নাগরিকেরাও। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রামের সভাপতি ডা. মুজিবুল হক খান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার বাসা ৮ তলায়। সেখানেও মশা। চসিকের প্রতি আহবান থাকবে তারা যেন মশা দমনে আরো তৎপর হয়। ডেঙ্গুতে ভয়ের কিছু নেই। চিকিৎসকের পরামর্শে চলতে হবে।’

মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী এএম জিয়া হাবীব আহসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সন্ধ্যার পর থেকে মশার জন্য ঘরের দরজা জানালা বন্ধ রাখতে হয়। সিটি কর্পোরেশনকে একসাথে পরিচ্ছন্ন অভিযান ও মশা দমন কর্মসূচি চালাতে হবে। পাশাপাশি জনগণকে এই কর্মসূচিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সিটি কর্পোরেশন সেটা পারেনি।’

সিটি কর্পোরেশন মশা দমনে যে ওষুধ ছিটায় সেগুলো কার্যকর নয় দাবি করে তিনি বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশন কার্যকর ওষুধ দিলে তো মশা মরবে। তখন আর ওষুধের ব্যবসা চলবে না।’

গত দুই বছর ধরে মশা মারতে যে ওষুধ ছিটিয়েছিল সিটি করপোরেশন, পরীক্ষার পর দেখা গেছে সব ওষুধ ছিল অকার্যকর। অথচ অকার্যকর ওই ওষুধই কেনা হয়েছিল দুই কোটি টাকায়। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সিটি মেয়র রেজাউল করিম মশা নিধনে নেন ১০০ দিনের ক্র্যাশ কর্মসূচি। তার এই কর্মসূচিও আলোর মুখ দেখেনি।

এতো ওষুধ ছিটানোর পরও মশা নিধন না হওয়ায় ওষুধের কার্যকারিতা যাচাই করে দেখতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুরোধ জানান সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে দেয়। তারা সিটি করপোরেশনের ব্যবহৃত দুটি ওষুধসহ মোট ছয়টি ওষুধ পরীক্ষা করেন। এতে মাত্র একটি ওষুধের কার্যকারিতা পান তারা। অকার্যকর ওষুধগুলোর ব্যবহার বন্ধ করে কার্যকর ওষুধটি ব্যবহারের সুপারিশ করেন কারিগরি টিমের বিশেষজ্ঞরা। পরে এটি পরীক্ষামূলক ব্যবহার করলেও ওষুধটি কেনেনি সিটি করপোরেশন। সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ওষুধটির ব্যবহারে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ছাড়পত্র নেই।

এদিকে ৩০ নভেম্বর সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় মশা নিধন কার্যক্রম নিয়ে কাউন্সিলরদের তোপের মুখে পড়েন উপপ্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরশেদুল আলম চৌধুরী। এ সময় ওষুধ কেনা নিয়ে প্যানেল মেয়র আবদুস সবুর লিটন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি মোবারক আলীর মধ্যে বাগবিতণ্ডাও হয়েছে। এরপর সভায় আবারও পরীক্ষামূলক ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!