মনোনয়নের এক ঝড়ে সাজানো ঘর হল তছনছ

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন

মেয়রের পর এবার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদের মনোনয়নেও বড় চমক দিল ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এক ডজনেরও বেশি প্রভাবশালী কাউন্সিলর এবার দলীয় মনোনয়ন চেয়েও পাননি। এদের মধ্যে ৪ বার নির্বাচিত হওয়া কাউন্সিলর যেমন আছেন, তেমনি আছেন প্রথমবারের মত নির্বাচিত হওয়া প্রতাপশালী কাউন্সিলররাও। যাদের বিরুদ্ধে ছিল বিভিন্ন অভিযোগ। তবে দলীয় মনোনয়ন থেকে বাদ পড়া এসব কাউন্সিলরদের সবার একটা জায়গায় বেশ মিল। বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবেই পরিচিত তারা।

১৪ নম্বর লালখানবাজার ওয়ার্ডের টানা তিনবার নির্বাচিত কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন এএফ কবির আহমদ মানিক। এবারের চসিক নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে পাননি তিনি। চলতি মেয়াদে বারবার দ্বিপক্ষীয় সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে এই ওয়ার্ডে। ঘটেছে রাজনৈতিক প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুনোখুনির ঘটনাও। কাউন্সিলর মানিক স্থানীয় সাংসদ ডা. আফসারুল আমীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এই ওয়ার্ডে এবার মনোনয়ন পেয়েছেন প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য আবু হাসনাত মোহাম্মদ বেলাল।

১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ড থেকে তিন মেয়াদে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন মোহাম্মদ হোসেন হীরন। এক সময় প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে পরিচিত এই মেয়র খুলশী থানা আওয়ামী লীগের আহবায়কের দায়িত্বও পালন করছেন। গত নির্বাচনে আজম নাছির মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর স্রোত বদলে নাছিরের বলয়ে রাজনীতি শুরু করেন হীরন। এবারে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন তিনিও। এই ওয়ার্ড থেকে এবার মনোনয়ন পেয়েছেন ওমরগণি এমইএস কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী।

১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ড থেকে টানা দুই মেয়াদে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি মোর্শেদ আকতার চৌধুরী। একসময় মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত নগর আওয়ামী লীগের এই সদস্য গত নির্বাচনের পর থেকে আজম নাছিরের সাথে সখ্য বাড়িয়ে সমালোচিত হয়েছেন নিজ বলয়ের নেতাকর্মীদের কাছে। তরুণ ও জনপ্রিয় এই কাউন্সিলরের সাথে স্থানীয় সাংসদ আফসারুল আমীনের খুব একটা সখ্য ছিল না। এবারে এই ওয়ার্ড থেকে মনোনয়ন চেয়েও পাননি মোর্শেদ। মনোনয়ন পেয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইসমাইল। স্থানীয় সাংসদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত মো. ইসমাইল।

নগরীর ৩১ নং আলকরণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেক সোলায়মান সেলিম। এই ওয়ার্ড থেকে ৪ বার কাউন্সিলর নির্বাচিত হলেও এবার দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি। তিনিও মহিউদ্দিনের বলয় থেকে গতবার যোগ দিয়েছিলেন আজম নাছির উদ্দিনের বলয়ে। এই মেয়াদে দায়িত্ব পালনকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় নাম এসেছে তার। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে হকার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, রিয়াজুদ্দিন বাজারকেন্দ্রিক বিভিন্ন সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। এবার এই ওয়ার্ডে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন মো. আব্দুস সালাম। মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত এই নেতা আলকরণ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য।

৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড থেকে গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন জহুরুল আলম জসিম। আ জ ম নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত এই কাউন্সিলর দায়িত্বের পুরো মেয়াদে ছিলেন ব্যাপক সমালোচিত। পাহাড় কাটা, ভূমি দখল, সিএনজি অটোরিকসার স্ট্যান্ড বসিয়ে চাঁদা তোলা, মাদক ব্যবসাসহ নানান অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। তবে এই ওয়ার্ডের বেশিরভাগ ভোটার সন্দ্বীপের হওয়ায় ভোটের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান রয়েছে জসিমের। এছাড়া উন্নয়নও করেছেন বেশ। তবে এসব উন্নয়নে অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। অভিযোগ আছে এক মেয়াদে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন জসিম। এবার এই ওয়ার্ডে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন জসিম। তার বদলে মনোনয়ন পেয়েছেন পাহাড়তলী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আবছার মিয়া।

৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডে হাসান মুরাদ বিপ্লবও এবার মনোনয়ন বঞ্চিত হলেন। আ জ ম নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত এই নেতা ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য। দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন কারণে আলোচনা-সমালোচনায় ছিলেন তিনি। তবে তার হাত ধরে উন্নয়নও হয়েছে এই ওয়ার্ডে। এবারে এই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন। প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী তিনি।

২৮ নম্বর পাঠানটুলী ওয়ার্ডে গতবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন আব্দুল কাদের। আ জ ম নাছিরের অনুসারী সাবেক এই ছাত্রনেতা নানা কারণে নগরে আলোচিত। কাউন্সিলর হওয়ার আগে ১৯টি মামলা ছিল তার বিরুদ্ধে। যদিও পরে রাজনৈতিক বিবেচনায় বেশিরভাগ মামলা প্রত্যাহার করা হয়। তবে কাউন্সিলর হওয়ার পর আগ্রাবাদ এলাকায় হকার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, সদরঘাটে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসাসহ নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত ছিলেন তিনি। এবার এই ওয়ার্ডে মনোনয়ন পেয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম বাহাদুর। সাবেক এই কাউন্সিলর স্থানীয় রাজনীতিতে মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী।

১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তৌফিক আহমেদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে হাটহাজারী থানায় একটি খুনের মামলা রয়েছে। ২০১৬ সালে নূর এলাহী নামের এক যুবলীগ কর্মী খুন হন। এ মামলার আসামি তিনি। এ ছাড়া কোতোয়ালী থানায় তার বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র মামলা রয়েছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিস্তর অভিযোগ এই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে।

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!