মনের রোগে ১১ জেলার ভরসা চমেক হাসপাতালের ২৩ শয্যা

চট্টগ্রামের একজন পিএইচডি করা বিজ্ঞানী যখন বলেন, আমার ভাইপোকে জিনে পেয়েছে। তখন ভাবি, কোন্ জগতে আছি আমরা।

কেউ করছে চিৎকার চেঁচামেচি, কেউ গান ধরেছে বেসুরো গলায়, কাউকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে, শিকল পায়ে কেউ হাঁটাহাঁটি করছে, কেউ কেউ সামনে যা পাচ্ছে তা ছুঁড়ে মারছে, কেউ আবার মায়ের কাছে ছোট্ট বাবুর মতো বায়না ধরেছে, কাউকে আবার হাত পা বেঁধে সিটে ফেলে রাখা হয়েছে। এমনই বিচিত্র পরিবেশ দেখা যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে।

মানসিক রোগের চিকিৎসায় চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলার মানুষের একমাত্র ভরসা ২৩ বেডের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগ। যেখানে সরকার অনুমোদিত ২০টি ও ৩টি অতিরিক্ত বেড রাখা হয়েছে। রোগী বাড়লেও এখনো বাড়েনি হাসপাতালে বেডের সংখ্যা। জনবহুল নগরী চট্টগ্রামে যেখানে আলাদাভাবেই একটা মানসিক হাসপাতাল স্থাপন করা দরকার, সেখানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৩ বেডের মানসিক বিভাগ এতো এতো রোগীর চিকিৎসা চালানোর জন্য পর্যাপ্ত না।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ২৩ বেডের বিপরীতে ৫০ জন রোগী ভর্তি আছেন। যাদের মধ্যে ২৫ জন পুরুষ ও ২৫ জন মহিলা। এই ওয়ার্ডে ডাক্তার রয়েছেন ৩ জন ও নার্স রয়েছেন ৯ জন, যারা সময় ভাগ করে কাজ করেন।

খাদিজাতুল কোবরা (ছদ্মনাম) ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম বোর্ড থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল। তার সহপাঠীরা অনেকে কলেজের মাঠে পা রাখলেও খাদিজাতুল কোবরার এখনো সেই সৌভাগ্য হয়ে উঠেনি। কারণ তার জায়গা হলো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক ওয়ার্ডে। চুপচাপ, আনমনা কখনো কখনো পায়চারী করেই তার দিন কাটে।

খাদিজাতুলের মা বললেন, আমার মেয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসার পরেই এমন হয়ে যায়। সব পরীক্ষাগুলো সে ভালভাবেই দিয়েছিল। কিন্তু বিজ্ঞান পরীক্ষার দিন হলে দায়িত্বরত শিক্ষক নেকাব খোলার জন্য তাকে জোর করেন। মেয়ে নেকাব না খুললে তার খাতা নিয়ে ফেলেন শিক্ষক। যার কারণে আসমা অনেক কিছু লিখতে পারেনি। সেদিন বাসায় ফেরার পর থেকে মেয়ে আমাকে বলে তার অনেক মাথা ব্যাথা করছে। কিছু না খেয়ে শুয়ে পড়ে। তারপর থেকেই দেখি মেয়ে আমার খাওয়া দাওয়া করেনা, কারোর সাথে কথা বলেনা। সারাক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। আমরা অনেক ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজের আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। গত ২-১ মাস ধরে আমার মেয়ের অবস্থা আরো বেশি খারাপ হয়ে গেছে। তাই মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। এখনো তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগ
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগ

খাদিজাতুলের ভাই বললেন, বোনের চিকিৎসা করাতে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। রোগী বেশি হওয়ার কারণে আমার বোনের জন্য সিট পেয়েছি ফ্লোরে।যে পরিমাণ রোগী চট্টগ্রাম মেডিকেলে মানসিক বিভাগের ওয়ার্ড সংখ্যা আরো বাড়ানো উচিৎ। চট্টগ্রামে আলাদাভাবেই একটা মানসিক হাসপাতাল স্থাপন করা দরকার, সেখানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৩ বেডের মানসিক বিভাগে এতো এতো রোগীর চিকিৎসা চালানো সত্যি অনেক দুঃখজনক।

কক্সবাজার থেকে নুরজাহান বেগম তার ছেলে আজিমের (৩৫) চিকিৎসা করাতে এসে মাসের পর মাস পরে আছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক ওয়ার্ডে। ছেলের বেডের নিচেই পাতলা কাপড় বিছিয়ে নিজের শোয়ার জায়গা করে নিয়েছেন নুরজাহান বেগম। হাত পা বাঁধা অবস্থায় বেডে শুয়ে আছে নুরুল আজিম। হাত পা বাঁধা থাকলেও তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করছেন আজিম।

নুরজাহান বেগম দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, দুই-তিন বছর আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে আমার ছেলের মাথায় আঘাত লাগে। তারপর থেকেই সে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায়। তাকে বাড়িতেও বেঁধে রাখা যায় না। সেই থেকে মাসের পর মাস কেটে যাচ্ছে হাসপাতালে। এখানে এসে চিকিৎসায় একটু ভালো লাগে। কিন্তু বাড়িতে গেলে আমার ছেলে আবার অসুস্থ হয়ে যায়। রোগীর জন্য আরও অতিরিক্ত ২ জন মানুষ থাকতে হয়। যার ফলে এখানে থাকা খাওয়া কষ্ট হয়ে যায়।

কক্সবাজার উখিয়া থেকে আমিনা এসেছেন তার স্বামীকে। তিনি জানান, আজ ১৫ দিন ধরেই হাসপাতালে পড়ে আছি। আমার স্বামী যখন বেশি অসুস্থ হয়ে যায়, তখন সে আমায় খুব মারধর করে। এমনকি বাচ্চাদেরও অনেক মারে। ওকে ঘরে আটকে রাখতে পারি না। আমাদের মেরে ধরে বের হয়ে যায়। কিছু দিন পরপরই হাসপাতালে নিয়ে আসি। কিন্তু হাসপাতালে এত রোগীর জায়গা নেই। শুধুমাত্র চিকিৎসার জন্য থাকতে বাধ্য হই। মানসিক রোগীগুলোকে শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে রাখা দরকার। কিন্তু সেখানে হাসপাতালের চারপাশে অন্যান্য রোগীদের চিৎকার চেঁচামেচিতে রোগী আরও উশৃংখল হয়ে যায়। অনেক সময় রোগীর সিরিয়াস অবস্থা। কিন্তু ডাক্তার পাওয়া যায়না। আমাদের জেলাতে এই ধরনের রোগীদের চিকিৎসা হয় না। অনেক দূর থেকে এসে চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক বিভাগের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে কর্তব্যরত সিনিয়র স্টাফ নার্স খালেদা বলেন, মানসিক ওয়ার্ডে কাজ করা খুবই কষ্টকর। অনেক সময়তো রোগীদের মাইরও খাওয়া লাগে। কি করবো, ওরা তো মানসিক রোগী। কিছুই বুঝে না। আমাদের ওয়ার্ডে ৩ জন ডাক্তার ও আমরা ৯ জন নার্স রয়েছি। সময় ভাগ করে কাজ করি।

তিনি আরও বলেন, ২৩ বেড নিয়ে মানসিক বিভাগের এই ৩ নম্বর ওয়ার্ড। রোগী বেশি হলে সমস্যা হয়ে যায়। অনেক সময় ১০০ জনেরও বেশি রোগী হয়, যখন তাদের জায়গা এবং সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন জানিয়েছি যেনো মানসিক বিভাগে অতিরিক্ত ওয়ার্ড এবং জনবল বাড়ানো হয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগ
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগ

চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজ ও হাসপাতালের মানসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক মহিউদ্দীন এ সিকদার দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা না দিয়ে অনেক সময় ঝাড়ফুঁক বা তাবিজ-কবজ দেওয়া হয়। গ্রামের কথা না হয় বাদ দেওয়া গেলো। কিন্তু দেখা যায় আমাদের শিক্ষিত সমাজ থেকেও এই সব কুসংস্কারের ছায়া এখনো কাটেনি। চট্টগ্রামের একজন পিএইচডি করা বিজ্ঞানী যখন বলেন, আমার ভাইপোকে জিনে পেয়েছে। তখন ভাবি, কোন্ জগতে আছি আমরা।

তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম বিভাগে সরকারি কোন বিশেষায়িত মানসিক হাসপাতাল নেই। আমাদের চট্টগ্রামের সব মানুষের ভরসা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৩ বেডের এই মানসিক বিভাগ। সেখানেও সরকার অনুমোদিত মাত্র ২০টি বাকি ৩টি অতিরিক্ত রাখা হয়েছে। এই বিভাগে অধ্যাপকের কোন পদ নেই। আমরা মাত্র তিনজন চিকিৎসক রয়েছি। আমাদের দু’জন চিকিৎসকের পদ খালি রয়েছে।

রোগীদের সেবা নিয়ে তিনি বলেন, যতক্ষণ ফ্লোরে জায়গা রয়েছে, এতক্ষণ পর্যন্ত যত রোগীই আসুক না কেনো তাদের সেবা না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়না। তাদের সেবা, খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হাসপাতাল থেকেই করা হয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক আখতারুল ইসলাম বলেন, একটা হাসপাতালে কতো সিট বরাদ্দ করবে সেটা সরকারের ব্যাপার। তবে রোগী যখন বেশি হয়ে যায়, তখন অতিরিক্ত বেডের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। অতিরিক্ত বেড সবসময় দেয়া হলে রোগীর স্বজনরাই সেখানে শুয়ে থাকে। কিন্তু রোগী যতই হোক না কেনো কেউ সেবা না পেয়ে হাসপাতাল থেকে যায় না।

ডাক্তার সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, ডাক্তারের সংকট আছে। কারণ মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি কঠিন হওয়াতে এই বিষয় নিয়ে কেউ তেমন পড়াশোনা করতে ইচ্ছুক নয়। মানসিক রোগী দেখতে দেখতে অনেক ডাক্তারের মাথাও খিটখিটে হয়ে যায়। এধরনের রোগীদের চিকিৎসা করাও অনেক কষ্টকর। যার কারণে শুধু এখানে না, সারাদেশেই মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সংকট রয়েছে। সারাদেশে মিলে হয়তো ১০০ জনের মতো মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রয়েছেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহসিন উদ্দিন আহমেদ দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ওয়ার্ড সংখ্যা বাড়ানো, ডাক্তার নিয়োগ এসব সময়ের সাথে সাথে বাড়বে। ডাক্তারের পদ থাকলেও বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই নিয়োগ দিতে হয়।

এসএ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!