কোর্ট হাজতের বন্দি: সাক্ষাৎ বেআইনি, তবু মন তো আইন মানে না

‘কেমন আছ বাবা! বাবা, আমি তোমায় দেখতে পারছি না ভালো করে। আমি তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি না। একটু বড় করে বলো না। বাবা দেখ, এটা আমার মোবাইল (খেলনা মোবাইল)। মামা কিনে দিয়েছে। তুমি অতো ওপরে উঠে আছ কেন? বাবা পড়ে যাবে তো, নিচে নেমে যাও। আমি বাবার কাছে যাব…’— এভাবে কাঁদতে কাঁদতে মামার কাঁধে থাকা ৪ বছরের সাদিয়া কথা বলছিল তার বাবার সাথে।

বাবা মনির হোসেন চট্টগ্রাম আদালতের লকআপের ভেতরে। তার সামনে মস্ত বড় দেয়াল। দেয়ালে অবশ্য চিড়িয়াখানার মতো করে উপরের অংশে লোহার জালি দেওয়া। সেটাই এখন একমাত্র মাধ্যম স্বজনদের সাথে দেখা করার। ভেতরে আসামিরা লকআপের উপরে উঠে হাঁটু গেড়ে বসলেও বাইরে থাকা স্বজনরা তাদের কাছের মানুষটিকে একনজর দেখতে পায়। একটু কথা বলতে পারে। যদিও একে অন্যের কথা কিছুই শুনতে পায় না। কিন্তু তাও কাছের মানুষকে একনজর দেখতে দূরদুরান্ত থেকে এসে হাজির হয় আসামির স্বজনরা।

চট্টগ্রাম আদালতের হাজতখানায় এখন টাকার বিনিময়েও স্বজনরা আসামির সাথে দেখা করতে পারছে না। জানা যায়, পাঁচ থেকে ছয় মাস আগে হাজতে গিয়ে আসামির সাথে দেখা করতো স্বজনরা, যেটা কোনোভাবেই আইনসিদ্ধ ছিল না। এ কারণে চাঁদাবাজি, বিভিন্ন অপকর্ম বেড়ে গিয়েছিল হাজতখানায়। তাই বর্তমানে সেটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন আর টাকার বিনিময়েও বন্দিদের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হচ্ছে না কারোর।

তারপরও ভালোবাসার কাছে অপরাধ যেন কিছুই না। কেউ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে, আবার কেউ অপরাধ না করেও হাজতবাস করছেন চট্টগ্রাম কারাগারে। প্রিয়জন যতই অপরাধী হোক না কেন, তাকে দেখার জন্য দূরদুরান্ত থেকে স্বজনরা এসে হাজির হচ্ছে হাজতখানার সামনে। ভেতরে প্রবেশ করতে না পারলেও সামান্য একটু দেখার অপেক্ষায় হাজতখানার বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে কারো স্ত্রী-সন্তান, কারও বাবা, কারও মা কিংবা কারো ভাই বা স্বজন।

বায়েজিদ থেকে লাভলী তার চার বছরের মেয়ে সাদিয়া আর ভাই হোসেনকে নিয়ে কারাগারে এসেছিলেন স্বামী মনির হোসেনের সাথে দেখা করতে।

লাভলী বললেন, ‘আমার স্বামী মনির হোসেন অস্ত্র মামলার আসামি। ৬ মাস ধরে জেলে আছে। সে যতই অপরাধী হোক না কেন আমাদের মন তো আর মানে না। মেয়েটাও কান্নাকাটি করে সবসময়। তাই আসি স্বামীর সাথে দেখা করতে। কিন্তু আসলেও ভেতরে ঢুকতে পারি না। দূরে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকি— সে কখন লকআপের উপরে উঠবে তার অপেক্ষায়। উপরে উঠলেই তখন একটু দেখতে পাই। ও (স্বামী মনির) ওপাশ থেকে কথা বলে, আমরা এ পাশ থেকে বলি। কিন্তু কে কী বললাম কিছুই বুঝতে পারি না। অনেক সময় পুলিশ ভেতরে ওকে মেরে নামিয়ে দেয়। কী আর করব— তাও আসি এখানে একটু দেখার জন্য।’

‘বাবা কেমন আছস! খাইতে পারছস তো! শরীরডা ভালা আছে তো! বাড়িতে সবাই ভালা আছে চিন্তা করিস না’— এমন করেই লক আপে থাকা ছেলে রহিমুদ্দিনের সাথে কথা বলছিলেন খাগড়াছড়ি থেকে আসা তার বাবা কামাল উদ্দিন।

কামাল উদ্দিন লেন, ‘আমি খাগড়াছড়ি থেকে আসি ছেলের সাথে দেখা করতে। এসে তেমন ভালো করেতো কথায় বলতে পারি না। কিন্তু তারপরও আসি। মন মানে না বাড়িতে। ছেলেটা কেমন আছে জানতে ছুটে আসি এখানে। এসে ওই দূর থেকে যা একটু দেখতে পাই। কী আর করার, ভেতরে যাওয়ার অনুমতি নেই।’

চট্টগ্রাম আদালতের হাজতখানার সামনে গার্মেন্টসকর্মী রুনা বেগম জানান, ‘আমি এসেছি আমার ছেলের সাথে দেখা করতে। অপরাধ না করলেও আমার ছেলেটাকে ধরে নিয়ে আসলো। সারাদিন কাজ করি, সময়ও পাই না। আজকে এলাম ছুটি নিয়ে ছেলের সাথে দেখা করতে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ছেলের দেখা পেলাম একটু। কষ্ট লাগছে একটু ভালো করে কথাও বলতে পারলাম না।’

ভাইয়ের সাথে দেখা করতে আসা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি আমার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছি। এখন অবশ্য ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। সেটা ভালোই হয়েছে। এতে করে পুলিশের চাঁদাবাজিটা কমেছে। তিন-চার মাস আগে যখন আসতাম তথন ভেতরে ঢুকতে পারলেও টাকা ছাড়া ঢুকতে দিত না পুলিশ। যে যত বেশি টাকা দিত, তাকে আগে ঢুকতে দিত।’

উল্লেখ্য, সোমবার (৪ নভেম্বর) চট্টগ্রামের মেট্রো কোর্টের হাজতখানায় মো. সিরাজ (২২) নামে এক আসামি স্বজনকে দেখার আশায় লক আপের উপরে উঠতে গিয়ে পেছনে ফ্যানের সাথে ধাক্কা লেগে মাথায় আঘাত পান। এতটা ঝুঁকির মাঝেও আসামিরা অপেক্ষা করে কখন একপলক তার স্বজদের দেখা পাবে। স্বজন আসার কথা জানতে পারলেই হাজতখানার লকআপে উঠে ঠাঁয় বসে থাকে কাছের মানুষগুলোকে একনজর দেখতে।

হাজতখানায় দায়িত্বরত কয়েকজন পুলিশের সাথে কথা বললে তারা জানান, হাজতখানায় প্রবেশের কোনো নিয়ম নেই। পাঁচ-ছয় মাস আগে প্রবেশের সুযোগ থাকলেও তারা নিজেরাই নিজেদের সুযোগ নষ্ট করেছে। এখন টাকার বিনিময়েও ভেতরে ঢোকা যায় না।

হাজতখানার ইন্সপেক্টর আরিফ হোসাইন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ছয়মাস আগেও স্বজনরা আসামিদের সাথে হাজতখানায় দেখা করতে পারত। স্বজনরা আসামিদের জন্য রান্না করে আনতো, খাওয়াতো। একে অপরের সান্নিধ্যে আসতে পারতো। কিন্তু এটা নিষিদ্ধ করেছে হাজতখানা কর্তৃপক্ষ। আসামির আইনজীবী ছাড়া আর কেউ প্রবেশ এখানে করতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, স্বজনদের দেখতে না পেয়ে আসামিরা খুব অস্থির হয়ে যায়। তারা ছোটাছুটি করে এদিক থেকে ওইদিকে শুধুমাত্র স্বজনদের এক পলক দেখার জন্য। হুড়োহুড়ি করে লক আপের উপরে উঠে পড়ে। দেখা করতে না পারলে হাজতে খুব চিল্লাচিল্লি করে, দেয়ালে লাথি মারে। তখন তাদের কন্ট্রোল করা যায় না। কিন্তু কিছুই করার নেই। নিয়ম যেটা, সেটা তো মানতে হবে।

আদালতের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (প্রসিকিউশন) মো. কামরুজ্জামান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, জেলা কারাগারেই আসামির সাথে দেখা করা যায়। কিন্তু হাজতখানায় আসলে স্বজনদের প্রবেশের অনুমতি নেই। এখানে শুধু আইনজীবীদের প্রবেশের অনুমতি আছে। কিন্তু এতদিন স্বজনরা হাজতখানায়ও আসামির সাথে দেখা করতো, যেটা কোনোভাবে আইনের আওতায় ছিল না। আমরা আইন মেনে চলার চেষ্টা করছি এবং সাধারণের ভেতরে প্রবেশ আটকাতে পারলাম। এতে অনেক দিক থেকেই সুবিধা হয়েছে। যদিও স্বজনদের মন মানে না। তারা আসে দেখা করতে তাদের কাছের মানুষের সাথে। কিন্তু করার কিছু নেই আইন মানতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস সভাপতি অ্যাডভোকেট জিয়া আহসান হাবিব চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, হাজতখানায় বা কারাগারে আসামিদের সাথে দেখা করতে না দেওয়ার মতো অমানবিক কাজ আর কিছু হয় না। কারাগার হচ্ছে আসামিদের জন্য সংশোধানাগার। আসামিদের সংশোধন করার জন্যই কারাগার, তাদের বন্দি করে রাখার জন্য নয়। হাজতখানা বা কারাগারে আসামিদের তাদের স্বজনদের সাথে দেখা করতে দেওয়া উচিত। বাইরের দেশগুলোতে তো আসামিদের সাথে তার স্বজনদের দেখা করতে দেয়া হয়। এছাড়া স্ত্রীকে স্বামীর সাথে থাকতেও দেওয়া হয়। সপ্তাহে, মাসে বা বিশেষ বিশেষ দিনে স্বজনদের সাথে আসামিদের দেখা করতে দেওয়া উচিত। আসামিরা স্বজনদের সাথে দেখা করতে না পারলে তো তারা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমি মনে করি, হাজতখানা হোক বা কারাগারই হোক, আসামির সাথে তার স্বজনদের দেখা করতে দেওয়াটাই মানবিক।

সিআর

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!