ভ্যাট-ট্যাক্স ফাঁকিতে বিএসআরএম, সাড়ে ১৩ কোটির ঘটনা ধরা পড়ার পর ‘ভুল’ স্বীকার

৬৬ কোটি টাকার আয়কর ফাঁকির অভিযোগ ওঠে নভেম্বরে

সাড়ে ১৩ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার ঘটনার ধরা পড়ার পর এবার সেই টাকা পরিশোধে বাধ্য হল চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বিএসআরএম। স্টিল পণ্য উৎপাদনকারী এই প্রতিষ্ঠানটিতে ভ্যাট গোয়েন্দা অভিযানে চালানোর পর সেখানে সাড়ে ১৩ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার ঘটনার ধরা পড়ে। এরপর বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) সরকারি কোষাগারে ভ্যাটের সেই টাকা শোধ করেছে বিএসআরএম।

এর আগে গত নভেম্বরেও বিএসআরএম স্টিল মিলস লিমিটেডের বিরুদ্ধে ৬৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আয়কর ফাঁকির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ওঠে। অন্যদিকে বিএসআরএমের বিরুদ্ধে করের টাকা ফাঁকির অভিযোগ ওঠেছে এক বছর আগেও। সেই সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চট্টগ্রাম কমিশনারেটের অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড দেশের ভেতরে পণ্য বিক্রি করে তা বিদেশের রপ্তানি দেখিয়ে অন্তত ১১০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছে।

এদিকে সম্প্রতি বিএসআরএম গ্রুপের স্টেইনলেস স্টিল পণ্য উৎপাদনকারী দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত করে অপরিশোধিত ভ্যাটের তথ্য উদঘাটন করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর।

নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের (মূল্য সংযোজন কর) মহাপরিচালক ড. মইনুল খান জানিয়েছেন, বিএসআরএমের এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিএসআরএম স্টিল মিলস লিমিটেড চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে অবস্থিত। অন্যদিকে বিএসআরএম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড চট্টগ্রামের সদরঘাট রোডের আলী ম্যানশনে অবস্থিত।

বিএসআরএম স্টিল মিলস

ভ্যাট গোয়েন্দার উপ-পরিচালক মুনাওয়ার মুরসালীনের নেতৃত্বে পরিচালিত এক তদন্তে দেখা যায়, ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সময়কালে বিএসআরএম স্টিল মিলস লিমিটেড বিভিন্ন সেবার বিপরীতে উৎসে ভ্যাট বাবদ ২৮ কোটি ৩৬ লাখ ১৪ হাজার ২৭৪ টাকা প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি উৎসে ভ্যাট বাবদ সরকারি কোষাগারে জমা করেছে ২১ কোটি ৭৪ লাখ ২৩ হাজার ৯৮৩ টাকা। এক্ষেত্রে ৬ কোটি ৬১ লাখ ৯০ হাজার ২৯১ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা উদঘাটন করা হয়। এর ওপর ভ্যাট আইন অনুসারে ২ শতাংশ হারে ২ কোটি ১৯ লাখ ৭৯ হাজার ৫৮৩ টাকা সুদ প্রযোজ্য।

অন্যদিকে ওই সময়ে বিএসআরএম স্টিল মিলস লিমিটেড স্থান ও স্থাপনার ভাড়ার বিপরীতে ৯৩ লাখ ৭০ হাজার ৩০ টাকা পরিশোধ করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে পাওনা ভ্যাটের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ১৭ লাখ ৪৪ হাজার ৯৩৯ টাকা। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ২৩ লাখ ৭৪ হাজার ৯০৯ টাকার তথ্য উদঘাটন করা হয়। স্থান ও স্থাপনার ভাড়ার বিপরীতে এই অপরিশোধিত ভ্যাটের উপরও ভ্যাট আইন অনুসারে ২ শতাংশ হারে ১০ লাখ ৯ হাজার ২৫৭ টাকা সুদ প্রযোজ্য।

বিএসআরএম স্টিল রি-রোলিং মিলস

অপরদিকে বিএসআরএম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত সময়কালের কার্যক্রম তদন্ত করা হয়। তদন্ত মেয়াদে বিভিন্ন সেবার বিপরীতে উৎসে ভ্যাট বাবদ ১১ কোটি ৭০ লাখ ৮৪ হাজার ৯৩৭ টাকা প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি উৎসে ভ্যাট বাবদ ৮ কোটি ৭৪ লাখ ১২ হাজার ৭৭০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়। এ ক্ষেত্রে ২ কোটি ৯৬ লাখ ৭২ হাজার ১৬৭ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা উদঘাটন করা হয়। এর ওপর ভ্যাট আইন অনুসারে ২ শতাংশ হারে ১ কোটি ৭ লাখ ৯৮ হাজার ৯০৪ টাকা সুদ প্রযোজ্য।

এছাড়া ওই সময়ে বিএসআরএম স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড স্থান ও স্থাপনার ভাড়ার বিপরীতে ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার ২৩৮ টাকা পরিশোধ করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির ভ্যাট দিয়েছে ৪১ লাখ ৯১ হাজার ২৪৪ টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ৭ লাখ ১৮ হাজার ৬ টাকার তথ্য উদঘাটন করা হয়। স্থান ও স্থাপনার ভাড়ার বিপরীতে এই অপরিশোধিত ভ্যাটের উপরও ভ্যাট আইন অনুসারে ২ শতাংশ হারে ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪১৫ টাকা সুদ প্রযোজ্য।

এই দফায় মোট ১৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা

এই তদন্ত মেয়াদে প্রতিষ্ঠান দুটির অপরিশোধিত ভ্যাটের পরিমাণ ৯ কোটি ৮৯ লাখ ৫৫ হাজার ৩৭৩ টাকা এবং সুদ বাবদ ৩ কোটি ৪০ লাখ ৩১ হাজার ১৫৯ টাকাসহ সর্বমোট ১৩ কোটি ২৯ লাখ ৮৬ হাজার ৫৩২ টাকা রাজস্ব ফাঁকির তথ্য উদঘাটিত হয়।

এদিকে বিএসআরএম কর্তৃপক্ষ তাদের ‘ভুল’ স্বীকার করে বৃহস্পতিবার (২৯ ডিসেম্বর) সরকারি কোষাগারে ফাঁকি দেওয়া ভ্যাটের টাকা শোধ করে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তরকে সেটা জানিয়েছে। ভ্যাট আদায় হওয়ায় বিএসআরএমের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা দুটি নিষ্পত্তির জন্য ভ্যাট কমিশনারেট চট্টগ্রামকে জানানো হয়েছে।

৬৫ কোটি টাকা আয়কর ফাঁকি

এর আগে গত নভেম্বরে বিএসআরএম স্টিল মিলস লিমিটেডের বিরুদ্ধে ৬৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা আয়কর ফাঁকির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ওঠে। ২০১৬-২০১৭ সালের হিসাব নিরীক্ষাকালে বিএসআরএম স্টিল মিলসের কর নথি, বার্ষিক নিরীক্ষিত হিসাব বিবরণী ও রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে এই অনিয়ম পেয়েছে ঢাকা কর কমিশনারের কার্যালয়ের অডিট বিভাগ।

অডিট বিভাগের প্রতিবেদনে অনিয়মের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, করদাতা কর্তৃক আয়কর রিটার্নের সঙ্গে দাখিল করা বার্ষিক অডিট রিপোর্টে (২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর) শেয়ার ক্যাপিটাল বৃদ্ধি ১৮৭ কোটি ১৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা প্রদর্শন করা হলেও আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এর ধারা ১৯ (২৪)-এর বিধান অনুযায়ী ওই বিনিয়োগের টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন করা হয়েছে এমন কোনো প্রমাণপত্র আয়কর নথিতে পাওয়া যায়নি। ফলে ওই ধারার বিধান অনুযায়ী বিনিয়োগকৃত টাকা করদাতার আয় হিসাবে গণ্য এবং মোট আয়ের সঙ্গে যোগযোগ্য হলেও তা করা হয়নি।

তবে বিএসআরএম কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে জানিয়েছে, ওই অডিট রিপোর্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন।

১১০ কোটি টাকার কর ফাঁকি

এক বছর আগেও বিএসআরএমের বিরুদ্ধে করের টাকা ফাঁকির অভিযোগ ওঠে। সেই সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চট্টগ্রাম কমিশনারেটের অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড দেশের ভেতরে পণ্য বিক্রি করে তা বিদেশের রপ্তানি দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকার কর ফাঁকি দিয়েছে কোম্পানিটি। কর ফাঁকির এই অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে বিএসআরএম কর্তৃপক্ষকে এনবিআর থেকে চিঠি দেওয়া হলেও চিঠিতে উল্লেখিত নিয়মের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যায় প্রতিষ্ঠানটি।

এনবিআরের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রফতানিকৃত বলিয়া গণ্য’ সংজ্ঞার আওতায় পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে মূল্য সংযোজন কর বিধিমালা আইনের অপব্যবহার করে পণ্য সরবরাহের বিপরীতে গৃহীত বিধি বহির্ভূত প্রত্যর্পণ ও অপরিশোধিত মূসকের হিসেবে সরকারকে ১১০ কোটি ৫৬ লাখ ৪৮ হাজার ৭১৫ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। বিভিন্ন কর মেয়াদে দাখিলকৃত দলিলাদি ও দফতরের সংরক্ষিত রেজিস্ট্রার যাচাইয়ের মাধ্যমে এই ফাঁকির তথ্য খুঁজে পাওয়া গেছে।

এর মধ্যে ২০১৬ সালের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএসআরএম প্রায় আড়াই হাজার টন পণ্য সরবরাহের বিপরীতে শুল্ককর প্রত্যর্পণ নিয়েছে তিন কোটি ৫৬ লাখ টাকা, আর ভ্যাট পরিহার করেছে ১৪ লাখ টাকা। অন্যদিকে ২০১৭ সালে দুই ধাপে প্রায় ১০ হাজার টন পণ্য সরবরাহের বিপরীতে শুল্ককর ও ভ্যাট ফাঁকি ১২ কোটি টাকার ওপরে। আর ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ৮৯ হাজার টন পণ্য সরবরাহের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি শুল্ককর প্রত্যর্পণ নিয়েছে ৯১ কোটি টাকা। আর ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে তিন কোটি ৪৪ লাখ টাকা।

সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহ করা পণ্য ‘রফতানি বলে গণ্য’ দেখিয়ে ১০৬ কোটি টাকার শুল্ককর ও চার কোটি টাকার ভ্যাট অপরিশোধিত রাখে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!