ভোরের দুর্ঘটনায় ছিন্নভিন্ন পরিবার, লুকিয়ে কাঁদছেন সবাই

দুই কন্যা নিয়ে নিশ্চিন্তপুরে এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাবেন বাবা

৯০ বছর বয়সী মা আয়েশা রহমান বুঝে উঠতে পারছেন না কেন বাসার সবাই মুঠোফোনে এতো ব্যস্ত। ফোনের ওপাশে কি কথা হচ্ছে তা বুঝতে না পারলেও কান্না কান্না চোখ দেখে কিছু একটা হয়েছে তা আন্দাজ করতে পারছেন। মা আয়েশা রহমান ব্যতিব্যস্ত হয়ে বারবার জানতে চাইছেন ছেলেরা চট্টগ্রামে তাড়াহুড়ো করে কেন গেল? বয়স্ক মা যেন না বুঝতে পারেন তাই আড়ালে মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন সবাই। মায়ের অস্থিরতায় ঘটনা পুরো না বললেও জানালেন একটা ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে।

আয়েশা রহমানের ১১ ছেলেমেয়েদের মাঝে ছেলেদের মধ্যে পঞ্চম জন বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক সাইফুজ্জামান খান মিন্টু। স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলে নিয়ে সাজানো সুখের সংসার মিন্টুর। স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসতেন এই ব্যাংক কর্মকর্তা। বড় মেয়ে ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। বাচ্চাদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ তাই ২৩ ডিসেম্বর লম্বা ছুটিতে ঢাকা থেকে বেড়াতে গিয়েছিলেন বান্দরবানে। বান্দরবান যাবার পথে মেয়েকে তুলে নেন ফেনীর স্কুল থেকে। শেষবারের মতন পরিবারের সবাই মিলে একসাথে হৈ-হুল্লোড় করে কাটিয়েছেন ছুটির এ কটা দিন। পরিবার নিয়ে ছুটি কাটিয়ে গন্তব্যে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় তছনছ হয়ে গেছে ব্যাংক কর্মকর্তার সাজানো সংসার। দুই মেয়েসহ না ফেরার দেশে মিন্টু। আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে।

এদিকে হাসপাতালের বিছানায় জ্ঞান ফিরতেই মিন্টুর স্ত্রী কনিকা জানতে চাইলেন দুই মেয়ের কথা। কথা বলার শক্তি না পেলেও ইশারায় মেয়েরা কোথায় আছে খোঁজ নেন। কনিকা জানেন না তার স্বামী সাইফুজ্জামান ও দুই মেয়ে আর কখনও তার কাছে ফিরবে না। মেয়েরা ছুটোছুটি করবে না আর মায়ের কাছে। রাখবে না আর কোনো আবদার।

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঢাকা থেকে হাসপাতালে ছুটে আসেন নিহত সাইফুজ্জামানের সেজো ভাই কুমিল্লার সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জেড আই মিজানুর রহমান খান, ছোট ভাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জেড আই মনিরুজ্জামান খান এবং বড় ভাই কক্সবাজার বিজিবির পরিচালক কর্নেল জেড আই নজরুল ইসলাম খান।

হাসপাতালের শয্যায় গুরুতর অবস্থায় নিহত সাইফুজ্জামান খানের স্ত্রী কণিকা
হাসপাতালের শয্যায় গুরুতর অবস্থায় নিহত সাইফুজ্জামান খানের স্ত্রী কণিকা

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাককে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন নিহত সাইফুজ্জামানের ছোট ভাই মনিরুজ্জামান খান। নিহত সাইফুজ্জামান খান মিন্টু বিজয় বসাকের বন্ধু।

বিজয় বসাক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একসাথে পড়েছি। একসাথে অনেক ভালো সময় কেটেছে আমাদের। সকালে এই ঘটনা জেনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। আকস্মিকভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় তাকে হারাবো তা কখনও ভাবিনি।’

মিন্টুর বড় ভাই নজরুল ইসলাম খানের বন্ধু নাসিরাবাদ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো.মোজাম্মেল হোসেনের বাসায় ফেরার পথে পরিবার নিয়ে বাসায় যাওয়ার কথা ছিল সাইফুজ্জামান খানের।

মোজাম্মেল হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সকালে নাস্তার টেবিলে টিভির স্ক্রলে দেখি সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিশু নিহত। তখন খুব আফসোস হয়, কষ্ট লাগে। এর কিছুক্ষণ পর আমার ভাইপো ফোন করে জানায় এমন ঘটনা। আমি আর আমার ছেলে ছুটে আসি হাসপাতালে। তার একটু পরেই ছটফট করতে করতে মারা যায় আমার বন্ধুর ভাই সাইফুজ্জামান খান। স্ত্রী আর ছেলে এখনও জানে না তাদের আপনজন আর নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘কথা দিয়েছিল, আমার বাসায় আসবে। ভাত খাবে। আমি বাজার সদাইও করি। কিন্তু এলো না। যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় সব শেষ হয়ে গেল।’

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে একে একে হাসপাতালে ছুটে আসেন পরিবারের সদস্য, বন্ধু, সহকর্মীরা। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেন কেউ কেউ।

নিহত সাইফুজ্জামানের কলেজ বন্ধু ইলিয়াস পলাশ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন,’ তিনদিন আগে আজকে আমাদের মিট করার কথা ছিল। আর তো দেখা হলো না আমাদের। আমার বন্ধুকে হারিয়ে ফেললাম। ঢাকা কলেজ থেকে একসাথে পড়াশোনা করেছি। আমার বন্ধু খুব ভালো মনের মানুষ ছিল। বুকটা ফেটে যাচ্ছে।’

আজগর আলী হাসপাতালের চাইল্ড স্পেশালিস্ট বড় ভাই নজরুলের স্ত্রী ডাক্তার নাসিম জাহান জেসি নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন,‘সবাই মিলে বেড়াতে গিয়েছিল ভালো সময় কাটাতে। কিন্তু ভালো সময়টা যে আজ এভাবে আসবে তা কখনোই ভাবিনি।’

ভাই মিজানুর রহমান খান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পরিবারের সবাইকে নিয়ে বান্দরবানে বেড়াতে গিয়েছিল। ফেরার পথে এত বড় একটি ঘটনা ঘটে গেছে। আমার ভাই দুই মেয়েকে নিয়ে চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে। ভাবি আর বাচ্চা চিকিৎসাধীন। আমি এখন তাদের কি জবাব দিবো। আমি সত্যিই জানি না। আমার বৃদ্ধা মা বারবার ফোন করছে একটা ভালো খবরের আশায়।’

পরিবারসহ সাইফুজ্জমান খান।
পরিবারসহ সাইফুজ্জমান খান।

তিনি আরও বলেন, ‘নিহত মিন্টু ও দুই মেয়ের লাশ নিয়ে সরাসরি চাঁদপুরের নিশ্চিন্তপুরে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানেই পারিবারিক কবরস্থানে দাফনকাজ সম্পূর্ণ করা হবে।’

জানা যায়, চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের সন্তান জেড আই সাইফুজ্জামান খান মিন্টু (৪৫)। পরিবারে পাঁচ ভাই ছয় বোনের মধ্যে মিন্টু দশম। ঢাকার মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যুগ্ম পরিচালক হিসেবে কর্মরত সাইফুজ্জামান খান মিন্টু পরিবার নিয়ে থাকতেন মিরপুর এলাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক পদে যোগ দিয়েছিলেন সাইফুজ্জামান। স্ত্রী কণিকা জামান খান (৩৯) গৃহিণী। বড় মেয়ে আশরা জামান খান (১৩) ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। মেঝ মেয়ে তাসনিম জামান খান (১১) ও ছেলে মন্টি খান (১০) ঢাকার একটি স্কুলের চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন জাহিদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কণিকার মাথায়, কোমরে ও হাতে গুরুতর জখম আছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। ছেলের মাথায় জখম বেশি। দুজনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। তবে কণিকার অবস্থা ছেলের চেয়ে কিছুটা উন্নত আছে।’

মিন্টুর স্ত্রী ও ছেলে- দুজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়িতে দায়িত্বরত পরিদর্শক জহিরুল হক ভূঁইয়া। এছাড়া পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়া তিনটি লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

প্রসঙ্গত, শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) সকাল ৮ টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সীতাকুণ্ড উপজেলার ফৌজদারহাট বাইপাস মোড়ে ঢাকামুখী প্রাইভেট কার ও চট্টগ্রামমুখী কনটেইনারবাহী লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই মারা যায় দুই মেয়ে। হাসপাতালে আনা হলে মাথায় গুরুতর আঘাত পাওয়ায় মারা যায় সাইফুজ্জামান খান। স্ত্রী ও ছেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৮ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিল।

এসআর/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!