ভোট আসতেই বেপরোয়া ইভানের কিশোর গ্যাং

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আয়োজন শুরু হতেই চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কিশোর গ্যাং। এর নেতৃত্বে রয়েছেন নগর পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সাদ্দাম হোসেন ইভান। কারাগারে থাকা নুর মোস্তফা টিনু গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে চকবাজারে তিনি পরিচিত। র‍্যাব ও পুলিশের কিশোর গ্যাং বিরোধী অভিযানের শুরুতে চকবাজার এলাকা ছেড়ে ইভান পালালেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে আবারও ফিরে এসেছেন।

জানা গেছে, তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সাদ্দাম হোসেন ইভান এবারের নির্বাচনে চকবাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ মনোনীত কাউন্সিলর প্রার্থী গোলাম সাঈয়েদ মিন্টুর অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে শুরু করেছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। ইভান গ্রুপের ৬০-৭০ কিশোর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চকবাজার ও কাতালগঞ্জ এলাকা। কথায় কথায় পিস্তলের বাট দিয়ে মারধর, ছুরিকাঘাত ও বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলছে তাদের। এমন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের আড়ালে চকবাজার থানা পুলিশের প্রশ্রয় রয়েছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। প্রশাসনের চোখে দীর্ঘদিন পালিয়ে রয়েছে এমন গ্যাং লিডাররাই এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এলাকায় এলাকায়। পুলিশ দেখেও না দেখার ভান করার বাড়ছে এই কিশোর অপরাধীদের।

চকবাজার থানার ওসি রুহুল আমিনের সঙ্গে ইভানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে— এমন অভিযোগ খোদ ভুক্তভোগীদেরই। আর ওই সম্পর্কের কারণে একের পর এক ঘটনা করেও পার পেয়ে যাচ্ছে ইভানের কিশোর গ্যাং। বিভিন্ন ঘটনায় অনেক নিরীহ লোক মারাত্মক আহত হওয়ার পরও কোনো মামলা নিচ্ছে না চকবাজার থানার পুলিশ। তবে ওসি রুহুল আমিন বিষয়টি অস্বীকার করে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইভানের বিরুদ্ধে কেউ কোন অভিযোগ করতে আসেনি। আর চকবাজার এলাকায় এমন কোন ঘটনাও হয়নি। ঘটনা না হলে আমি কি ঘটনা বানাবো?’

জানা গেছে, চকবাজারের বাসিন্দারা ইভানের কথা শুনলেই আঁতকে ওঠেন। গত ৬ দিনে ইভানের কিশোর গ্যাংয়ের হাতে চকবাজারে অন্তত তিনটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে বেশ কয়েকজন আহতও হয়েছে। একের পর এক হামলার ঘটনায় কয়েকজনের শরীর রক্তাক্ত হওয়ার পরও পুলিশ বলছে কোনো ঘটনা ঘটেনি। এছাড়া হামলার ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পরও পুলিশ বলছে এসব বানানো ঘটনা।

চকবাজারের কাউন্সিলর প্রার্থী গোলাম সাঈয়েদ মিন্টুর সঙ্গে সন্ত্রাসী সাদ্দাম হোসেন ইভান।
চকবাজারের কাউন্সিলর প্রার্থী গোলাম সাঈয়েদ মিন্টুর সঙ্গে সন্ত্রাসী সাদ্দাম হোসেন ইভান।

জানা যায়, ভুক্তভোগীরা ইভানের নামে চকবাজার থানায় অভিযোগ নিয়ে গেলে উল্টো হয়রানি শিকার হতে হয়। ইভানের নাম সরিয়ে অন্যদের নামে অভিযোগ দিতে বলা হয় পরোক্ষভাবে। এতে কোন অভিযোগকারী রাজি না হলে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি অভিযোগকারী ও তার সঙ্গে থাকা লোকজনের ছবি তুলে ওসি তাদের দেখে নেওয়ারও হুমকি দেন বলে অভিযোগ মিলেছে।

তবে এ বিষয়ে চকবাজার থানার ওসি রুহুল আমিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এসব তথ্য সঠিক না।’ তিনি রেগে গিয়ে উচ্চস্বরে বললেন, ‘আপনি কি আমার থেকে জানতে চান, নাকি জানাতে চান?’

চকবাজারে টিনু গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে পরিচিত ইভান এখন নগর ছাত্রলীগ সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমুর অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেন এলাকায়। চট্টগ্রাম সরকারি সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইমুর অনুসারী পরিচয়ে কলেজেই সময় কাটান বেশিরভাগ। টিনু গ্রেপ্তার হয়ে জেলে থাকায় ইমুর নাম ভাঙিয়ে চলেন এই কিশোর গ্যাং লিডার।

এ বিষয়ে নগর ছাত্রলীগ সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইভানকে আমি ভালোভাবেই চিনি। আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক বেশ ভালো। জানামতে ইভান ভালো ছেলে। এরপরও যদি চকবাজারে কোন অপরাধ করে, তাহলে তারা থানা পুলিশের আশ্রয় নিতে পারে।’

গত ৩ জানুয়ারি ইভানের ‘ছোট ভাই’ হিসেবে পরিচিত আল রশিদ আবিরের নেতৃত্বে সাত জনের একটি কিশোর গ্রুপের হামলার শিকার হয়ে মারাত্মকভাবে মাথায় আঘাত পান চকবাজারের আল ফারুক অপটিক্যালসের মালিক মোহাম্মদ ফারুক। আবির ও তার বন্ধুরা মোহাম্মদ ফারুকের ছেলে আবু বক্কর সিদ্দিকীর সাথে কথা কাটাকাটির জের ধরে এ হামলা চালায়।

ঘটনার দিন দুপুর ১২টার দিকে চকবাজারের কেয়ারী শপিং মলের সামনে আবির ও আবু বক্কর সিদ্দিকির কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়। বিকালে দুজনের মধ্যে সমঝােতা হলেও গ্যাং লিডার সাদ্দাম হোসেন ইভান এ সমঝােতায় নারাজ ছিলেন। তাই ইভানের নির্দেশে রাত আটটায় আল ফারুক অপটিক্যালে হামলা চালায় আবিরের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি কিশোর গ্যাং।

দোকানের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, আবির একটি লম্বা লোহার রড দিয়ে দোকানের মালিক ফারুকের মাথায় আঘাত মারতে থাকে এবং ফারুকের ছেলে আবু বক্কর ছিদ্দিক তার বাবাকে বাঁচাতে আসলে তাকেও গ্রুপের অন্য সদস্যরা বেধরক মারতে থাকে। পাশের দোকানদার ও পথচারীদের সহযোগিতায় পিতা-পুত্রকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়।

৭ জানুয়ারি রাতে পাঁচলাইশ থানার মোড়ে বাস থেকে নামিয়ে ইভান ও জয়নগরের তুষারের নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র কিশোর গ্রুপ আবির নামে এক যুবককে ছুরিকাহত করে গুরুতর আহত করে। তারা বাস থেকে নামানোর পর আবিরকে পিস্তলের বাট দিয়ে আঘাত করে তাকে মাটিতে ফেলে দেয়। এরপর সন্ত্রাসীরা আবিরের পায়ের রানে ছুরিকাঘাত করে। এ নিয়ে পাঁচলাইশ থানায় এদের নামে একটি অভিযোগ করা হয়েছে।

চকবাজারে ইভানের নিয়ন্ত্রণাধীন কিশোর গ্যাং গ্রুপের আবার রয়েছে একাধিক উপগ্রুপ। যেখানে চট্টগ্রাম ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ, চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজসহ স্থানীয় কিছু কিশোরদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন ৭০-৮০ জনের কিশোর গ্যাং। এদের মধ্যে নাঈমুল হাসান প্রকাশ ভাঙারী তুষার, মোহাম্মদ নাজমুল তোফা, শিহাব হাসান, নাদিম উদ্দিন, তাসকিম হোসেন, সায়েম জয়, কামরুল হাসান, অন্তর কর, রবিউল হাসান শাফি, হাবিবুর রহমান, তানজীদ মাহাবুব, জিদান, হোসাইন তাহসান, এস এম সামাদের নাম উঠে আসে নানা ঘটনার পর।

এ বিষয়ে জানতে সাদ্দাম হোসেন ইভানের মোবাইলে একাধিকবার চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!