ভোটের মাঠে ভাড়ায় খাটছে চট্টগ্রামের ৪৭ কিশোর গ্যাং, প্রার্থীর টাকায় কেনা হচ্ছে অস্ত্র

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে টার্গেট করে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ভাড়ায় খাটছে অন্তত ৪৭টি তালিকাভুক্ত সক্রিয় কিশোর গ্যাং। নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোটগ্রহণের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে হাল আমলের এই কিশোর গ্যাং কালচার। নির্বাচনী সভা ও মিছিলে মারামারিতে কাজে লাগানোর পাশাপাশি ভোটের দিনে আধিপত্য বিস্তারের জন্য এসব কিশোর গ্যাংকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানোর শঙ্কাও রয়েছে প্রবলভাবে।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বারেবারেই কিশোর গ্যাংকে দমানোর হুঁশিয়ারি দিয়ে এলেও নগরীর বেশ কয়েকটি থানা সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে কিশোরগ্যাংকে। নগরীর চকবাজার, ডবলমুরিং, বায়েজিদসহ বেশ কয়েকটি থানার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) করা তালিকা অনুযায়ী নগরীতে মোট ৪৭টি সক্রিয় গ্রুপের ৫৩৫ জন সদস্য রয়েছে। যাদের সব গ্রুপের কাছে আছে অবৈধ দেশি ও বিদেশি অস্ত্র। তবে কিশোর গ্যাংয়ের সবচেয়ে বেশি আধিপত্য রয়েছে চকবাজার ও কোতোয়ালী থানা এলাকায়। যারা ইতিমধ্যেই ভাড়ায় কাজ করছে এসব এলাকার বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে।

জানা গেছে, মোটা টাকার বিনিময়ে নির্বাচনী মাঠে আধিপত্য ধরে রাখতে অনেক প্রার্থীই এসব গ্যাংকে ভাড়ায় খাটাচ্ছেন। আবার কোথাও কোথাও রাজনৈতিক হিসাবনিকাশের জেরে ভোটের মাঠে মারমুখী হয়ে অবস্থান নিচ্ছে তারা।

নগরীর সহিংস কিশোর গ্রুপের তালিকার প্রথম দিকে থাকা ইভান প্রকাশ পিস্তল ইভান এবারের নির্বাচনে চকবাজার ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টুর হয়ে নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় আছেন। নির্বাচনী প্রচারণায় চকবাজারে এখন পর্যন্ত ছোটখাট যেসব সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে তার নেতৃত্বে ছিলেন ইভান।

এমন চিত্র নগরীর প্রায় সকল ওয়ার্ডেই। ধর্ষণ মামলার আসামি, খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত, চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ও অস্ত্রব্যবসায়ীদের নিয়ে দলভারী করছেন প্রার্থীরা। ২৮ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুরের নির্বাচনী প্রচারণায়ও এলাকার চিহ্নিত অপরাধী ও কিশোর গ্রুপ লিডারদের দেখা যাচ্ছে। যাদের মধ্যে হত্যামামলার আসামি, কমার্স কলেজ রোডের মাসুদ রানা বিপ্লব ,মোগলটুলীর আবু তাহের, নির্বাচনী সহিংসতায় বাবুল হত্যাকাণ্ডের সময় অস্ত্র হাতে গ্রেপ্তার হওয়া মেহেদি হাসান জিয়া, পাঠানটুলীর ইয়াবা ব্যাবসায়ী আলী হোসেন রানা, ধর্ষণ মামলার আসামি আলী আক্কাস জুয়েল প্রকাশ কালা জুয়েল অন্যতম। নির্বাচনে প্রতিপক্ষের কর্মী-সমর্থকদের চাপে রাখতে এসব কিশোরগ্যাং লিডারদের ব্যবহার করছেন বাহাদুর— ইতিমধ্যে এমন অভিযোগ এনেছেন প্রতিপক্ষ প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা।

চকবাজারের যুবলীগ নেতা আবদুর রউফ ও এসরারের গ্রুপের অনেকগুলো উপগ্রুপ এবারের নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। যাদের নিয়ন্ত্রণে আছে চকবাজার, জামালখান, চন্দনপুরা, রহমতগঞ্জ, বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, কালুরঘাট এলাকার বড় অংশ।

চকবাজারে রয়েছে কয়েকটি উপ দলও— যাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন গিয়াস সিদ্দিকী প্রকাশ পিস্তল গিয়াস, নাহিদুল জাবেদ প্রকাশ টেম্পু জাবেদ, নূর নবী প্রকাশ ধুট নবী, শহীদুল হক প্রকাশ ধামা মিন্টু। এছাড়া রয়েছেন পাঁচলাইশের জসিম উদ্দিন সুমন প্রকাশ পিস্তল সুমন, শাহাদাত প্রকাশ লেংড়া রিফাত, আমির প্রকাশ ইয়াবা আমির, মো. জুলহাস ও কাপাসগোলার অরিত্র দাশ।

মুরাদপুর, নাসিরাবাদ ও পাঁচলাইশের একাংশের নিয়ন্ত্রক শিবির ক্যাডার মো. ফিরোজের কিশোর গ্যাং। অন্যদিকে দুই নাম্বার গেট, জিইসি, জাকির হোসেন রোড, নাসিরাবাদ এলাকার ডন কথিত যুবলীগ নেতা সোলাইমান বাদশার কিশোর গ্রুপটি। বায়েজিদ বোস্তামী থানার নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা, পলিটেকনিক ও শেরশাহ এলাকায় রয়েছে আবু মোহাম্মদ মহিউদ্দীনের কিশোর গ্যাং। যুবলীগ নেতা ও সাবেক বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা সাইফুল আলম লিমন গ্রুপের রাজত্ব রয়েছে সিআরবি, কদমতলী, আমবাগান-টাইগারপাস ও নন্দনকানন এলাকায়।

এদিকে কিশোর গ্যাং লিডার হিসেবে আলোচিত পাহাড়তলীর জহুরুল আলম জসিম, লালখানবাজারের আবুল হাসনাত বেলাল ও চান্দগাঁওয়ের এসরারুল হক এসরার কিশোর গ্যাংয়ের বলে নিজেরাই কাউন্সিলর পদে লড়ছেন স্ব স্ব ওয়ার্ড থেকে।

নির্বাচনের কিশোর গ্যাংকে ভাড়ায় খাটানোর এই কালচারকে ভবিষ্যৎ সামাজিক প্রেক্ষাপটের জন্য বড় রকমের হুমকি বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে মূলত কিশোর গ্যাংগুলো নিজেদের শক্তিশালী করছে। নিজেদের গ্রুপের জন্য কিনছে দেশি-বিদেশি অস্ত্র, বাড়াচ্ছে সদস্য সংখ্যাও— যা পরবর্তীতে সমাজের জন্য ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘কিশোর গ্রুপ গুলোকে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা শেল্টার দেয়— এখানে লুকোচুরির কিছু নেই। আর শেল্টার দেওয়ার পিছনের কারণ হচ্ছে মাদক ও অস্ত্র বিক্রি।’

তিনি বলেন, ‘কিশোর গ্রুপের সদস্যদের মাদকে আসক্ত করতে পারলে নেতারা সহজেই মাদক বিক্রি করাতে পারবে। আর কখনও যদি টাকার অভাবে কিশোর গ্রুপের সদস্যরা নেশা করতে না পারে তখন তারা চুরি, ছিনতাই, খুনের মত খারাপ কাজে লিপ্ত হয়। তাই সমাজে বেড়ে যায় সন্ত্রাসী তৎপরতা।’

চবির এ সাবেক উপাচার্য বলেন, ‘সেজন্য রাজনৈতিক নেতাদের উচিত, কিশোর বয়সী বাচ্চাদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার না করা। যদি কিশোরদের এই সাব-কালচার বন্ধ না করা যায়, তবে দেশের জন্য একটি অন্ধকারময় ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।’

ড. ইফতেখার আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে হবে। এরকম যারা বিভিন্ন কিশোর গ্যাং কালচারের সাথে জড়িত, তাদের কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।’

তবে এই বিষয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে এই মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছুই করার নেই মন্তব্য করে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (জনসংযোগ) শাহ মো. আবদুর রউফ বলেন, ‘কোনো প্রার্থীর যদি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে তবে নির্বাচন কমিশনে জানাতে হবে। নির্বাচন কমিশন আমাদের আদেশ দিলে তারপর আমরা ব্যবস্থা নেবো। আমরা বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। তাই কমিশন যা বলবে আমরা তাই করবো। এর বাইরে কোন কাজ করার এখতিয়ার নেই আমাদের।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!