ভোটের মাঠে ছালামের উন্নয়নই আওয়ামী লীগের পুঁজি
সিটি কর্পোরেশনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে চান আবদুচ ছালাম
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র পদে কাকে দেখা যাবে— এই প্রশ্ন এখন সবখানেই। ফের আ জ ম নাছিরেই ভরসা রাখবে আওয়ামী লীগ, নাকি এই পদে পরিবর্তন আসবে— সে প্রশ্নের উত্তর যেন কিছুতেই মিলছে না। এই পরিস্থিতিকে আরও রহস্যের চাদরে ঢেকে দিয়েছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পুত্র মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন ‘মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার কোন আগ্রহ তার নেই। তবে এই পদে চমক আছে।’ কী সেই চমক— এই প্রশ্নের উত্তরে সবচেয়ে আগে যে নামটি আসছে, সেটি হচ্ছে আবদুচ ছালাম।
লোকমুখে প্রচলিত আছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে যিনিই মনোনয়ন পান না কেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান হিসেবে আবদুচ ছালামের মেয়াদে করা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজের তালিকা নিয়েই নামতে হবে ভোটের মাঠে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) আবদুচ ছালামের মেয়াদে ১০ বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকায় চট্টগ্রাম শহরে ৩০টি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এর বাইরে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প চলমান কিংবা প্রায় সম্পন্ন হওয়ার পথে।
একনাগাড়ে ১০ বছর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের পুরো সময়জুড়ে আবদুচ ছালামের ওপর ছিল প্রধানমন্ত্রীর ধারাবাহিক আস্থা। এই সময়ে চট্টগ্রামের উন্নয়নে সরকারের নেওয়া সব প্রকল্পেই একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছিলেন ছালাম। জাতীয়ভাবে আলোচিত কর্ণফুলী টানেল, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প, আউটার রিং রোড, এলিভেটর এক্সপ্রেসওয়ের মত সব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের বাস্তবায়নের ভার তার হাতেই তুলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। চসিক নির্বাচনে তার আগ্রহের কথাও সবারই জানা। চসিক নির্বাচনের পূর্ব মুহুর্তে সিডিএর দায়িত্ব থেকে ছালামকে সরিয়ে সিটি নির্বাচনের জন্য বিশেষ কোনো ছক আঁকা হলো কিনা— তা নিয়েও আলোচনা ছিল বছরজুড়ে।
এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর হাত ধরে রাজনীতিতে আসা ছালামের সাথে নওফেলের সম্পর্কও বেশ ভাল যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে নিজের অনাগ্রহ থাকলেও অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে মেয়র পদে ছালামই তার সমর্থন পাবেন— এমন আশার কথা বলছেন ছালামের শুভাকাঙ্ক্ষীরা। ছালামও বলছেন, মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন চাইবেন তিনি। তবে এই বিষয়ে দলীয় প্রধান যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই মাথা পেতে নেবেন তিনি।
চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে আবদুচ ছালাম বলেন, ‘আমাদের দল বিশাল দল, প্রার্থী অনেকেই। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমরা অনেকেই মনোনয়ন চাইবো, নেত্রী যাকে পছন্দ করবেন তাকে নিয়েই আমরা নির্বাচনী মাঠে আসবো।’
গত এক দশকে চট্টগ্রাম শহরের অনেকগুলো সড়ক ছালামের সময়ে এক লেন থেকে চার লেনে উন্নীত হয়েছে। চট্টগ্রামে উড়াল সড়ক নির্মাণের প্রথম উদ্যোগও তিনিই নেন। এমনকি কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের কাজটি শুরুর ক্ষেত্রেও তার উদ্যোগই ছিল সবচেয়ে বেশি।
সিডিএ চেয়ারম্যান থাকাকালে আবদুচ ছালাম ৩০টিরও বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। এর মধ্যে ১৫টি সড়ক সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে সাগরিকা সড়ক, ঢাকা ট্রাংক রোড, পাঠানটুলি রোড, সদরঘাট রোড, ফিরিঙ্গিবাজার রোড, আন্দরকিল্লা জংশন থেকে লালদীঘি পর্যন্ত সড়কের সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন, সিরাজদ্দৌলা সড়ক, বহদ্দারহাট থেকে গণি বেকারি পর্যন্ত সড়ক, অলি খাঁ মসজিদ থেকে অক্সিজেন পর্যন্ত সড়ক, বায়েজিদ বোস্তামী সড়ক, ডিসি রোড, অক্সিজেন থেকে কুয়াইশ সড়ক ও বহদ্দারহাট থেকে কালুরঘাট সড়ক।
এছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন করেছেন তার মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম কলেজের অবকাঠামো উন্নয়ন, প্যারেড ময়দান সংস্কার, বহদ্দারহাট জংশন ও দেওয়ানহাটে ওভারপাস নির্মাণ, অনন্যা আবাসিক প্রকল্প, কল্পলোক আবাসিক প্রকল্প, মেহেদীবাগ অফিসার্স কোয়ার্টার, বিপণি বিতান নতুন ভবন, সিডিএ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সিডিএ গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা ও ভবন নির্মাণ, সল্টগোলায় কর্মজীবী নারীদের জন্য দেশের প্রথম ডরমিটরি নির্মাণ, কাজীর দেউড়ি কাঁচাবাজার ও অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স নির্মাণ এবং অক্সিজেনে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ।
নিজের প্রার্থিতার যৌক্তিকতা তুলে ধরে আবদুচ ছালাম বলেন, ‘আমি ১০ বছর সিডিএর দায়িত্ব পালন করেছি। কতটুকু কী করতে পেরেছি তা সবাই দেখেছেন। সিডিএ একটি ছোট প্রতিষ্ঠান। তার তুলনায় নগরীর উন্নয়নে কাজ করার জন্য সিটি কর্পোরেশন অনেক বড় প্ল্যাটফর্ম। সিটি কর্পোরেশন প্রতি জনগণের চাহিদা অনেক। যা পুরোপুরি পূরণ করা কঠিন বলে অনেকে মনে করেন। আমি এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে চাই।’
সিডিএ চেয়ারম্যান হিসেবে নিজের সফলতার বিষয়ে ছালাম বলেন, ‘ছয় মেয়াদে দশ বছর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমি চেষ্টা করেছিলাম চট্টগ্রামকে উচ্চ আসনে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে যাত্রায় আমি সফল হয়েছি। গত ১০ বছরে চট্টগ্রামে যে উন্নয়ন হয়েছে তা একটি ইতিহাস। দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমে আমি দুই বছর মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিই। ধীরে ধীরে ওই খণ্ডিত পরিকল্পনা রূপ নেয় মহাপরিকল্পনায়। সেই পরিকল্পনার অনেকটা বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকিগুলো বাস্তবায়নের পথে। আমি মনে করেছি বন্দরবিহীন চট্টগ্রাম মূল্যহীন। তাই বন্দরকে ঘিরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিকল্পনা হাতে নিই। সেজন্য চট্টগ্রামের ফিডার রোডগুলো বড় করতে শুরু করলাম। চট্টগ্রামকে যানজটমুক্ত করতে পাঁচটি নতুন রোড নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। সম্পূর্ণ নতুন করে তৈরি করা হয়েছে ৪৩ কিলোমিটার রাস্তা। এছাড়া পুরাতন সড়কের ১০০ কিলোমিটার সম্প্রসারণ করা হয়েছে।’
নগর আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক আবদুচ ছালাম বলেন, ‘গার্মেন্টস খাতের রপ্তানির ৪০ শতাংশ যেতো চট্টগ্রাম থেকে। গার্মেন্টস খাতের মোট রপ্তানির হার ৪০ ভাগ থেকে নেমে এসেছে ১০ ভাগে। এটি শুধুমাত্র অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে হয়েছে। ঢাকা থেকে বিমানে চট্টগ্রামে ৪৫ মিনিটে চলে আসা গেলেও বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রাম শহর আসতে লাগে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। এসব কারণে বিদেশি বায়াররা নিরুৎসাহিত হচ্ছে। এসব সংকট নিরসনে নেওয়া হয় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। জলাবদ্ধতা নিরসনে ১০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। কর্ণফুলী টানেল আউটার রিংরোডের মত প্রকল্প আমরা করেছি।’
তিনি বলেন, ‘সবমিলিয়ে গত ১০ বছরে চট্টগ্রামের উন্নয়নে কাজ করার যে সুযোগ আমাকে প্রধানমন্ত্রী করে দিয়েছেন, তা করতে গিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা— সেটিই কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রামকে একটি বিশ্বমানের নগরী হিসেবে তৈরি করার চ্যালেঞ্জ নিতে চাই আমি।’
এআরটি/সিপি