ভূমিমন্ত্রীর এলাকাতেই ২০ লাখে বসুন্ধরার খতিয়ান, তহসিলদারের রিপোর্টে বিভ্রান্তিতে এসিল্যান্ড

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার জুলধা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহসিলদার আহমদ নুরের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি করার অভিযোগ ওঠেছে। অনুসন্ধানে তথ্য মিলেছে, একটি নামজারি মামলার প্রতিবেদনে তহসিলদার দুটি পৃথক স্মারক দেখিয়ে দুই প্রতিবেদন দিয়ে পূর্বের এসিল্যান্ড ও বর্তমান এসিল্যান্ডকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছেন।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, নামজারি মামলা নং-২৭১/০৮ মূলে ডাঙারচর মৌজার ৯১৮ খতিয়ানের বিএস ১৭৩০ দাগের ভূমি আবেদনের প্রতিবেদনে নয়-ছয় তথ্য দিয়েছেন। গত ১২ মে জুলধা ভূমি অফিসের (ক) ১০৭ নম্বর স্মারকের প্রতিবেদনে লিখেছেন ‘৯১৮ খতিয়ানের ১৭৩০ দাগের শূন্য দশমিক চার শূন্য শূন্য শূন্য একর ভূমি নিয়ে ২৭২৫ খতিয়ান সৃজন হয় এবং তা মোহাম্মদ হারুন এর ভোগদখলে আছেন।’ যা বিবাদীর পক্ষে গেছে। এই প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছিলেন সাবেক এসিল্যান্ড শিরীন আক্তারের কাছে। এর মধ্যে কর্ণফুলীতে নতুন এসিল্যান্ড হিসেবে যোগদান করেন সহকারী কমিশনার পিযুষ কুমার চৌধুরী।

তিনি যোগদান করার পর চলমান মিস মামলা (নম্বর ১১২/২২ ইং) বিষয়ে তহসিলদারের প্রতিবেদন চাইলেন। তাতে গত ৭ জুলাই তহসিলদার আহমদ নুর জুলধা ভূমি অফিসের অপর একটি স্মারকে (জুলধা ক-১১৪) নামজারি ২৭১/০৮ এর প্রতিবেদন দাখিল করেন। দেখা যায়, তিনি এবারে লিখলেন ‘হারুন সাহেব রেকর্ডীয় ধারাবাহিকতায় ১৭৩০ দাগের শূণ্য দশমিক চার শূন্য শূন্য একর ভূমি হারুনের দখলে নাই।’

অথচ এর ঠিক এক মাস আগে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন ‘দখলে আছেন’ বলে— যা বাদির বিরুদ্ধে যায়। এখন আবার বর্তমান এসিল্যান্ডকে একই বিষয়ে প্রতিবেদন দিলেন বাদির পক্ষে। এভাবে একবার বাদির পক্ষে এবং আরেকবার বিবাদীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে মোটা অঙ্কের সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, একই ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন স্মারকে প্রতিবেদন পাঠিয়ে সেবাপ্রার্থীদের হয়রানি করছেন ওই তহসিলদারসহ একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এমনটি একই নামজারি ফাইল থেকে পূর্বের প্রতিবেদন গায়েব করে নতুন প্রতিবেদন যোগ করে দিচ্ছে উপজেলা ভূমি অফিসের গুটিকয়েক কর্মচারী। যারা বিনিময়ে নিচ্ছেন অনৈতিক সুবিধা।

এ ঘটনায় বাদি ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আগে কে কী দিয়েছে আমি জানি না। ওই কপিও আমি পাইনি। তবে এখন আমার পক্ষে তহসিলদার প্রতিবেদন দিয়েছেন। আমার কাছে কপি সরবরাহ করেছেন।’ জানতে চাইলে বিবাদী মোহাম্মদ হারুন বলেন, ‘প্রথমে আমার পক্ষে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন তহসিলদার আহমদ নুর। কিন্তু এখন শুনছি আমার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিয়েছেন। তাহলে নিশ্চয় আমার থেকে বাদি বেশি টাকা দিয়েছেন। এজন্য তার পক্ষে প্রতিবেদন দিয়েছে। আমি বিষয়টি এসিল্যান্ডকে জানাবো।’

ওদিকে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ইউনিয়ন ভূমি অফিসে তহসিলদার হিসেবে আহমদ নুর যোগদানের পর ঘুষ বাণিজ্য, বিভিন্নভাবে হয়রানি, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ও খারিজ বাতিল করেছেন। আর এতে তার ‘সহযোগী’ হিসেবে কাজ করছেন বহিরাগত এয়ার মোহাম্মদ মিজান ও হেলাল নামে দুই যুবক। তারা ভূমি অফিসে সরকারি কর্মচারীর মতো টেবিল পেতে বসেছেন।

অনুসন্ধানে আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। মূল উৎস খতিয়ানে জায়গা না থাকা সত্ত্বেও জুলধা ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা ঢাকার বসুন্ধরা মাল্টি ট্রেডিং লিমিটেড (যার রেজিঃ নং সি ১৫০৪৩৮) নামক একটি কোম্পানিকে ১৮ দশমিক পাঁচ ছয় ছয় শূণ্য একর জমি খতিয়ান সৃজনে সহযোগিতা করেছেন। এলাকায় প্রচার রয়েছে ‘জুলধা ডাঙারচর মৌজার ৩১৪৯ নম্বর খতিয়ান করতে ২০ লক্ষ টাকার সুবিধা নিয়েছেন’। কিন্তু তহসিলদার তার সর্বৈব অস্বীকার করেন। যেখানে মূল বিএস খতিয়ানের ভলিয়মে জায়গা নেই জানার পরও জমি রয়েছে বলে ভুয়া প্রতিবেদন দিয়ে নামজারি করা হয়েছে। যার নামজারি জমাভাগ মামলা নং-২২০২/২১-২২ইং। এসিল্যান্ডের অনুসন্ধানে তথ্য মিলবে বলে ভূক্তভোগিরা জানিয়েছেন।

এমনকি এডিসি রেভিনিউ আদালতে রিভিশন মামলা থাকা সত্ত্বেও ৩১৯৮ নম্বর খতিয়ান সৃজনে প্রস্তাব ফর্ম দিয়েছেন তহসিলদার আহমদ নুর। জানা গেছে, উপজেলা এসিল্যান্ড অফিসের গুটিকয়েক কর্মকর্তাদের সাথে আঁতাত করে তহসিলদার ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ে ভূমি মালিকদের হয়রানিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। বর্তমান তহসিলদার আহমদ নুর ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন। যার তহশিল অফিস থেকে খাজনা আদায়কৃত রসিদের সুত্র ধরে সংশ্লিষ্ট জমি সরেজমিনে যাচাই করলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসবে। জমির আকার পরিবর্তন করে খাজনার রসিদ কেটে দেয়ার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে।

কর্ণফুলীর জুলধা গ্রামের একাধিক ভুক্তভোগীরা জানান, জরুরিভিত্তিতে দুর্নীতির সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা ও বদলি গ্রহণ করতে জেলা প্রশাসক, এসিল্যান্ডসহ উর্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

একই মামলায় দুই স্মরকে প্রতিবেদন ও অনিয়মের বিষয়ে জানতে টানা তিন দিন তহসিলদার আহমদ নুরের মুঠোফোনে কল করা হলেও ফোন রিসিভ করেননি। পরের দিন অন্য নম্বর থেকে কল করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পরে ‘আমি এ বিষয়ে জানি না’ বলে ফোন লাইন বিছিন্ন করেন।

কর্ণফুলী উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) পিযুষ কুমার চৌধুরী বলেন, ‘জনগণকে আইনসঙ্গত সেবা ও তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বঞ্চিত করা যাবে না। যদিও কেউ করে থাকে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!