ভুয়া সবই, তবু রোহিঙ্গার হাতে স্মার্টকার্ড!

ভুয়া জন্মনিবন্ধন, ভুয়া ঠিকানা—তবু আসল জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্টকার্ড পেয়েছিলেন তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নুর আলম ওরফে নুর মোহাম্মদ। টেকনাফ যুবলীগ নেতা ওমর ফারুক হত্যা মামলার এই আসামি গত রোববার (১ সেপ্টেম্বর) রাতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। তার কাছে পাওয়া স্মার্টকার্ড নিয়ে তোলপাড় পুরো অন্তর্জাল দুনিয়া। অনেকের প্রশ্ন, কিভাবে একজন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র পেলেন? কিন্তু ঘটনার দুই দিনেও বিষয়টি নিয়ে একেবারেই নির্বিকার চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিস।

‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পর বেরিয়ে আসে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নুর মোহাম্মদ ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ থানার হিলভিউ আবাসিক এলাকার ঠিকানায় বাংলাদেশী জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্টকার্ড তৈরি করেছিলেন। সেই কার্ডে নিজের নামকরণ করেছিলেন নুর আলম।

টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী জানিয়েছেন, গত ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিনই রোহিঙ্গা নূর মোহাম্মদ তার কন্যার কান ফোঁড়ানোর অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। এতে গরু-ছাগল জবাই করে আয়োজন করা হয় বড় ভোজের অনুষ্ঠান। আমন্ত্রিতদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা ডাকাত, সন্ত্রাসী ও রোহিঙ্গা ইয়াবা কারবারির দল। ১৯৯২ সালে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা নূর মোহাম্মদ হ্নীলা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জাদিমুরা এলাকায় এসে প্রথমে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে সেখানেই জমি কিনে বাড়ির মালিক হন।

টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেছেন, নূর মোহাম্মদ ওরফে নুর আলমের বিরুদ্ধে থানায় হত্যা, ডাকাতি, অপহরণসহ অনেক মামলা রয়েছে এবং তিনি পুলিশের মোস্ট ওয়ানটেড ছিলেন। রোহিঙ্গা নুর মোহাম্মদের বাংলাদেশে চারটি বাড়ি রয়েছে। তার মধ্যে একটি পাকা ভবন, একটি দুই তলা, একটি টিনের ঘর এবং অপরটি বাগানবাড়ি।

বন্দুকযুদ্ধের পর রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নুর মোহাম্মদের নামে স্মার্টকার্ড ফেসবুকে ভাইরাল হলে তা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়। তবে তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে কোনও তদন্তই করছে না চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কমিশন অফিস। অনুসন্ধান করে জানা গেছে, নুর মোহাম্মদ কার্ডে নিজের নামকরণ করেছিলেন নুর আলম। পিতার নাম কালা মিয়া এবং মাতার নাম সরু বেগম। জন্ম তারিখ ২৫ নভেম্বর ১৯৮৩ আর এনআইডি নম্বর ৬০০৪৫৮৯৯৬৩। কার্ডে উল্লেখ করা স্থায়ী ঠিকানা হল পশ্চিম ষোলশহর পার্ট-২, হিলভিউ রোড, ৪২১১ পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম।

২০১৬ সালে হালনাগাদ ভোটার তালিকা করার সময় জেলা নির্বাচন কমিশন অফিসে সশরীরে গিয়েই ছবি উঠানো, চোখ ও আঙ্গুলের ছাপ দিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি যে জন্মনিবন্ধন জমা দিয়েছিলেন তাতে নিজের স্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করেছিলেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায়। আর বর্তমান ঠিকানা ব্যবহার করেছিলেন পাঁচলাইশ ৩ নম্বর ওয়ার্ডের। সেই সময় ব্যবহার করা জন্মনিবন্ধনটির ১৭ ডিজিটের যে কোড নম্বর আছে তার ওয়ার্ড কোডও ৩ নম্বর পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের দেখানো হয়েছিল। পরবর্তীতে নুর আলম নামেই স্মার্টকার্ড পান রোহিঙ্গা নুর মোহাম্মদ।

এদিকে পাঁচলাইশ থানার হিলভিউ রোডে বার্মা কলোনির মামার বাড়ির যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে গিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে এই নামের ও ছবির কোনও ব্যক্তিই সেখানে ছিলেন না। এমনকি তাকে কোনও দিন কেউ দেখেননি। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে নুর আলমের জমা দেওয়া জন্ম নিবন্ধন যাচাই করে দেখা গেছে সেটিও ভুয়া। কিন্তু তার স্মার্টকার্ডটি আসল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে সংরক্ষিত রয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে কিভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্টকার্ড বানালেন রোহিঙ্গা নুর মোহাম্মদ? এর আগেও নির্বাচন কমিশনের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে হাটহাজারী উপজেলার ঠিকানায় রমজান বিবি নামে এক রোহিঙ্গা নারী ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে স্মার্টকার্ড বানিয়েছিলেন বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছিল। এমনকি তার ব্যবহৃত এনআইডির কোড নম্বর নির্বাচন কমিশনের সার্ভারেও হুবহু মিল ছিল। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই সামনে আসলো রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নুর মোহাম্মদ ওরফে নুর আলমের স্মার্টকার্ড জালিয়াতির ঘটনা।

নগরীর ৭ নম্বর পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোবারক আলী বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের যে ঠিকানা ব্যবহার করে স্মার্টকার্ড বানিয়েছেন নুর আলম। সেটা ২০১৬ সালের দিকে তিনি নিজেই নির্বাচন কমিশন অফিসে গিয়ে করেছেন। কিন্তু সেই সময় যে জন্মনিবন্ধন ফরম জমা দিয়েছেন সেটার একটি কোড থেকে জানতে পেরেছি তা ৩ নম্বর পাঁচলাইশ ওয়ার্ড থেকে ইস্যু করা। তবে ওই সময় তিনি ভোটার তালিকায় নিজের নাম উঠানোর সময় ৩ নম্বর থেকে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার হয়েছিলেন।’

জানতে চাইলে ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কফিল উদ্দিন খান বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। কেউ বিষয়টি নিয়ে আমার সাথে আলাপ করেনি। আর এই ধরনের মিসটেইক হলে হতেও পারে। তবুও কোনও তদন্ত হলে আমি দেখব।’

রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নুর আলমের স্মার্ট কার্ড নিয়ে ফেসবুক সরগরম হলেও বিষয়টি নিয়ে একেবারেই নির্বিকার জেলা নির্বাচন কমিশন অফিসার মুনীর হোসাইন খান। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি পত্রিকায় দেখেছি। তবে তার স্মার্টকার্ড নম্বর জানি না বলে তাই খোঁজ নিতে পারিনি। আর এ বিষয়ে তদন্ত করতে এখন পর্যন্ত আমাদের কোনও নির্দেশনাও নেই।’

তবে জেলা নির্বাচন অফিসারের এই ধরনের জবাবকে দায়িত্ব এড়ানোর সামিল বলছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যদি এনআইডি বা স্মার্টকার্ড পান তাহলে সেই দায় নির্বাচন কমিশনের অবশ্যই আছে। তবে সেখানে শুধু একা নির্বাচন অফিস নয়, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিও দায়ী। কেননা তাদের জন্মনিবন্ধন বা জাতীয়তার সনদপত্র ছাড়াতো নির্বাচন কমিশন কাউকে ভোটার তালিকায় নাম উঠাবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সময়কালে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গার নাম ভোটার তালিকায় উঠেছিল। সেসময় আমরা তা অনেক যাচাই বাছাই শেষে বাদ দিয়েছিলাম। এখন তো রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। এখন নির্বাচন কমিশনকে আরও সর্তক হতে হবে।’

রোহিঙ্গা নুর আলমের স্মার্টকার্ড বানানোর ঘটনায় নিজ থেকে তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া নির্বাচন কমিশনের অগ্রাধিকার ভিত্তিক কাজ বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এ নির্বাচন কমিশনার।

এ প্রসঙ্গে বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান খোন্দকার বলেন, ‘এ বিষয়ে কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগও করেনি। কোনও অভিযোগও দেয়নি।’

সিএমপির উপ কমিশনার (বিশেষ শাখা) আব্দুল ওয়ারিশ বলেন, ‘রোহিঙ্গা নাগরিকের স্মার্টকার্ড বানানোর বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা তা অবজার্ভ করছি। কিন্তু রোহিঙ্গারা যদি পাসপোর্ট বানাতে পারে সেই দায় সরাসরি আমাদের পুলিশের। কিন্তু এনআইডি বানানোর দায়টা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নির্বাচন কমিশনের। এখন তদন্ত করে বের করতে হবে এ কাজে কে কে জড়িত আছে।’

অন্যদিকে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে অনেক অসম্ভবই সম্ভব। টাকা পকেটে গেলে সব কিছুই হয়ে যায়। তাই কোন কোন জনপ্রতিনিধি ও নির্বাচন কমিশনের লোকজন জড়িত তা একটি সুষ্ঠু তদন্তে নিশ্চয় বের হয়ে আসবে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই জালিয়াতির মামলা করা উচিত।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!