ভুল চিকিৎসায় শিশুর মৃত্যু মাদার চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালে, মামলা নেবে না পুলিশ

ঠিক দুই মাস আগে মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালে পৃথিবীর মুখ দেখেছিল শিশুটি। আর জন্মানোর ঠিক দুই মাস পরই একই হাসপাতালে মরতে হল তাকে। মৃত জেনেও বাচ্চাটিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে (চমেক) পাঠিয়ে দিয়ে ঝামেলা থেকে বাঁচতে চেয়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এর আগেও কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে এ হাসপাতালে। এ নিয়ে মামলা করতে গেলে হালিশহর থানা পুলিশ মামলা নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। বরং হালিশহর থানার ওসি নিজেই চাপ প্রয়োগ করছেন— মামলা না করে হাসপাতালের সঙ্গে আপোষ করতে।

চট্টগ্রামের হালিশহর থানার বড়পোল এলাকায় বেসরকারি মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালে নার্স-চিকিৎসকদের অবহেলা, গাফিলতি ও ভুল চিকিৎসায় দুই মাস বয়সী শিশু সন্তানের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। বুকে কফ নিয়ে গত ১৬ নভেম্বর মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয় শিশুটিকে। এরপর বৃহস্পতিবার (১৯ নভেম্বর) সকালে ইনহেলার দেওয়ার পরপরই তার মৃত্যু হয় বলে পরিবারের অভিযোগ।

ভুল চিকিৎসায় মারা যাওয়া শিশু নিজাম উদ্দীনের মা বড়পোল এলাকার কোহিনুর আক্তার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সোমবার (১৬ নভেম্বর) রাত আটটার দিকে বাচ্চার বুকে কফ জমায় তাকে মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালের এইচডিইউতে ভর্তি করাই। তারপর থেকে বাচ্চার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হওয়ায় কেবিনে স্থানান্তর করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।’

তিনি বলেন, ‘কিন্তু পরদিন (১৯ নভেম্বর) ভোর ৬ টা ৪৫ মিনিটে মেক্সেফ, রোক্সাডেক্স ও ক্যাচিন নামে তিনটা ইনজেকশান দেওয়া হয় তাকে। তারপর আমি তাকে বুকের দুধ খাওয়াই। বাচ্চার অবস্থা তখনও স্বাভাবিক ছিল। সকাল সাতটার দিকে বাচ্চাকে ইনহেলার দিয়ে নার্সরা চলে যায়। তারপর থেকে আমার বাচ্চার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। তখন ডিউটি ডাক্তার রিয়াজ উদ্দীন এসে আমার বাচ্চাকে চেকআপ করেন। তারপর বলেন— রোগীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। আমার বাচ্চা কিন্তু তখনই মারা গেছে। ওর গা ঠান্ডা হয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডাক্তার, নার্সরা ভুল ঔষধ দিয়ে আমার বাচ্চাকে মেয়ে ফেলেছে। তারপর ৮টা ২৫ মিনিটে আমরা যখন বাচ্চাকে নিয়ে মেডিকেলে যাই তখন মেডিকেলের ডাক্তার বলে রোগী তো আরও আগে মারা গেছে।’

শিশুটির বাবার নাম মো. মোকাদ্দেস। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে নিজাম ছিল ছোট।

মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক রিয়াজ উদ্দীন বলেন, ‘সকালে বাচ্চাটির অবস্থা খুব বেশি খারাপ হয়ে যায়। তখন যদি পিআইসিউতে নেওয়া যেতো, তাহলে হয়ত শিশুটি বেঁচে থাকতো।’

শিশুদের জন্য স্পেশাল হাসপাতালে কেন এই ব্যবস্থা নেই— এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি কর্তৃপক্ষ জানেন, আমি তো শুধু চাকরি করি।’

এ বিষয়ে হাসপাতালের ম্যানেজার মো. এরফানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি স্থানীয় লোকজন ডেকে হট্টগোল শুরু করেন এবং রোগীর পরিবারকে হুমকি-ধমকি দেন।

ম্যানেজারের কাছে হাসপাতালের কোনো রেজিস্ট্রেশন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কিছু জানিনা এবং কোন কাগজ দেখাতে পারবো না।’

আটতলা ভবনের প্রথম তিনতলা মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার হাসপাতাল এবং ওপরের পাঁচতলা আবাসিক হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

মারা যাওয়া শিশুর চাচা মো. মঞ্জুর আলম বলেন, ‘হাসপাতালের গাফিলতির জন্যই আমার ভাতিজা মারা গেছে। ভাতিজার অবস্থা খারাপ হওয়ার পরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের একটা ফোন পর্যন্ত দেয়নি। উল্টো টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছে। অমানুষের মত ব্যবহার করছে আমাদের সাথে।’

মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার তিনদিনে প্রায় সময়ই নার্স, আয়া ও চিকিৎসকদের অবহেলার শিকার হয়েছেন উল্লেখ করে নিহত শিশুর পিতা মো. মোকাদ্দেস বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ চিকিৎসক কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। নার্সরা ডিউটিতে রাতে ঘুমিয়ে থাকে। তাদের ডাকলে উল্টো বকা শোনান। তারা যে ওষুধ আমার সন্তানকে দিয়েছে, তার মেয়াদ ছিল কিনা তাও আমরা জানি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘রোগীদের সুচিকিৎসা প্রদানে তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এসব কারণে আমার সন্তানের মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটন এবং মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার হাসপাতালের প্রতিটি অনিয়মের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’

তিনি বলেন, ‘ভুক্তভোগী পরিবার হালিশহর থানাতে অভিযোগ করতে গেলে হালিশহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে আপোষ করে ঘটনাটা শেষ করে দিতে বলেন। ওসি আরও বলেন, মামলা হলে বাচ্চাটিকে আবার কবর থেকে তুলতে হবে, আপনারা ভেবে দেখেন এখন কী করবেন?’

নিহতের মা কোহিনুর আক্তার বলেন, ‘ছেলের মৃত্যুর কারণ জানতে চাই। তারা খুঁজে বের করুক। আধ ঘন্টা আগেও ছেলে সুস্থ ছিল। কোথায় ভুল ছিল সেটাই তারা বের করুক। আমি তো শূন্য হয়েছি। আর কেউ যেন শূন্য না হয়।’

বিশ্বজিৎ/এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!