ভিসা ও টিকেট নিয়ে দেশে বসে আছে ৮৬ হাজার শ্রমিক, দরজা বন্ধ বিদেশের

দুর্দিনে অসহায় জনশক্তি রপ্তানিকারকরাও

তাদের কাছে ভিসা আছে, এমনকি এদের অনেকের আছে প্লেনের টিকেটও। কিন্তু তারা উড়ে যেতে পারছেন না প্রবাসের কর্মক্ষেত্রে। সুনির্দিষ্ট করে বললে, প্রবাসে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ এমন নতুন শ্রমিকের সংখ্যা অন্তত ৮৬ হাজার ৫০০ জন। অথচ ভিসা-টিকেটসহ অন্যান্য খাতে নতুন এইসব শ্রমিক ইতিমধ্যে খরচ করে ফেলেছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে করোনার আগে ছুটিতে এসে এক লাখেরও বেশি শ্রমিক এখন বাড়িতে আটকে আছেন। এমন অবস্থায় তারা আছেন বিদেশে চাকরি হারানোর ভয়ে। কারণ বেশিরভাগেরই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আরও তিন লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক উপার্জনহীন অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন বিভিন্ন দেশে।

রেমিটেন্সযোদ্ধাদের এখনকার গল্প এরকমই— যারা বিদেশে কাজ করে কষ্টার্জিত টাকা পাঠান দেশে। এই গল্প সেই প্রবাসীদের— যাদের কষ্টার্জিত মুদ্রার ওপর ভর করে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার বিশাল রিজার্ভ গড়ে তুলেছে। কিন্তু বিনিময়ে রেমিটেন্সযোদ্ধাদের ভাগ্যে সত্যিকার অর্থে তেমন কিছু জোটেনি। তাদের জন্য সেভাবে কোনো উদ্যোগও নেই সরকারের।

১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশি এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। তাদের বেশিরভাগই সেসব দেশে গিয়েছেন জনশক্তি রপ্তানিকারক সংস্থার মাধ্যমে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ তার প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে পেয়েছে ১৮.২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিটেন্স।

বিদেশে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে আটকে আছে ভিসা প্রসেসিংয়ে ব্যয় হওয়া তাদের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশে চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খরচ।

ভিসা ও টিকেট নিয়ে দেশে বসে আছে ৮৬ হাজার শ্রমিক, দরজা বন্ধ বিদেশের 1

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) জানিয়েছে, তাদের সদস্যভুক্ত ১ হাজার ৬০০ প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ শ্রমিককে বিদেশে পাঠিয়ে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবদান রাখছে। অথচ তারাই এখন ব্যবসার অনিশ্চয়তায় রীতিমতো পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। সরকারি প্রণোদনা থেকেও তারা বঞ্চিত।

বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘১ হাজার ৬০০ রিক্রুটিং এজেন্সিকে প্রতি মাসেই একটি বড় খরচ গুণতে হয়— কর্মচারীদের বেতন, বাড়ি ভাড়া, সার্ভিস চার্জ— বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব বহন করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রায় ৮৬ হাজার ৫০০ অভিবাসী শ্রমিকের ভিসা ছিল। তাদের মধ্যে অনেকের টিকেটও ছিল। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে তারা আর যেতে পারেনি। আমরাও এই শ্রমিকদের পেছনে ভিসা ও টিকেট বাবদ বড় অংকের টাকা খরচ করে ফেলেছি।’

বায়রা সদস্যরা করোনা মহামারিতে ব্যবসার ক্ষতি পূরণের জন্য সরকারের কাছে দুই হাজার কোটি টাকা আর্থিক সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন বুধবার (৯ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে। এর আগে গত জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া একটি চিঠিতেও তারা সহায়তা চেয়েছিল, কিন্তু সে ব্যাপারে এখনও কোনো সাড়া মেলেনি।

বায়রার মহাসচিব শামীম বলেন, ‘যদি সৌদি আরবগামী শ্রমিকরাও বাংলাদেশ ছাড়তে পারতো, তাহলেও আমরা কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারতাম। কিন্তু পরিস্থিতি কখন স্বাভাবিক হবে তা কেউই জানে না।’

অনুমান করা হচ্ছে, দেশে ছুটি কাটাতে আসা এক লাখেরও বেশি শ্রমিক করোনাভাইরাস মহামারিতে দেশে আটকা পড়েছেন। এদের অনেকের কাজের চুক্তির মেয়াদও ফুরিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। অন্যদিকে করোনার কারণে সৌদি আরব, আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অন্তত তিন লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক আটকে পড়েছেন।

শামীম জানান, প্রায় ৩ লাখ আটকেপড়া শ্রমিক বিনামূল্যের ভিসায় (এনওসি) মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আছেন। বিনামূল্যের ভিসা মানে তারা যে কোন জায়গায় এবং যে কোন কোম্পানির জন্য কাজ করতে পারেন। এই শ্রমিকদের নিজেদের উপার্জন নিজেদেরকেই করতে হয়। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে তাদের আয় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে, যা তাদেরকে ঠেলে দিয়েছে মানবেতর এক পরিস্থিতির মধ্যে।

‘সরকারের কাছে আমি দাবি জানাচ্ছি, এইসব শ্রমিককে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা দেওয়া হোক, যাতে তারা বিদেশে অন্তত টিকে থাকতে পারে’— বললেন বায়রা মহাসচিব শামীম।

বায়রার সাবেক সভাপতি নূর আলী বলেন, ‘এমন দুর্যোগে শ্রমিকদের জন্য সরকারকে আরও কিছু করতে হবে। শ্রমিকদের জন্য বিমান ভাড়া এবং চিকিৎসা খরচ এখনই কমানো দরকার। আমরা নিজেরা শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে প্রতি শ্রমিকের জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা অর্থসহায়তা দিয়েছি।’

বায়রার উপদেষ্টা আবুল বাশার আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘সৌদি আরব মাসখানেকের মধ্যে হয়তো তাদের দরজা খুলে দিতে পারে এবং বৈধ শ্রমিকদের গ্রহণ করতে পারে। দেশে আসা সব শ্রমিককেই আমরা ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু সরকারকেও এজন্য উদ্যোগী হতে হবে। সরকারের উচিত আরও বেশি রেমিটেন্সের জন্য নতুন দেশে চাকরির বাজার খোঁজা। বায়রাকেও সহায়তা করা উচিত সরকারের। কারণ রেমিটেন্স আয়ের সেতুটি তো আমরাই তৈরি করেছি।’

এদিকে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি লেখা এক চিঠিতে বায়রার সভাপতি বেনজির আহমেদ লিখেছেন, কোভিড-১৯ এর কারণে জনশক্তি রপ্তানিকারক সংস্থার মালিকরা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। প্রায় ১৬ হাজার কর্মচারী, অফিস ভাড়া এবং অন্যান্য ব্যয়ের জন্য মাসে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা বেতন দেওয়া ১৬০০ রিক্রুটিং এজেন্সির পক্ষে সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, ‘কোনো সরকারি সংস্থাকে দোষ না দিয়ে চলমান সংকট কমাতে সরকারের সাথে কাজ করতে হবে আমাদের। আমরা প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে ৮০ লাখ টাকা দিয়েছি এবং আরও দেওয়ার চেষ্টা করব।’

তিনি সংগঠনের সদস্যদের আর কোনো সিন্ডিকেট গঠন না করার আহ্বান জানিয়ে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর সিন্ডিকেটের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।

বাংলাদেশের পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে রেমিটেন্সের সামগ্রিক প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে এবং জনশক্তি রপ্তানির হার কমে যাওয়ার কারণে এর প্রভাব বেশ কয়েক বছর ধরে থাকবে।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আসা প্রবাসীরা সাধারণত দুই বা তিন বছরের চুক্তি করে থাকেন। এ কারণে বেশিরভাগ প্রবাসী প্রতি তিন বছরের মধ্যে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য। যদি এরা আবার বিদেশে ফিরে যেতে ব্যর্থ হয়, তাহলে রেমিটেন্স দ্রুত কমে যাবে।’

সিপি

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অবলম্বনে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!