ভারতের ভার নিতে চট্টগ্রাম বন্দর কতোটুকু সক্ষম?

ঝামেলা নেই মংলায়

ভারতকে সার্ভিস দেওয়ার মত চট্টগ্রাম বন্দরের প্রস্তুতি ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। তৈরি পোশাকসহ দেশের ৯২ শতাংশ পণ্য রফতানি ও আমদানি হয় চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দিয়ে। চাপ বেশি হলে দেখা দেয় জটিলতা। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্য কতটা প্রস্তুত— এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সবখানে।

ব্যবসায়ীদের দাবি, বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ যন্ত্রপাতি বৃদ্ধি, সেড বৃদ্ধি, দ্রুত কন্টেইনার ডেলিভারি বৃদ্ধি ও পার্কিং ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। তবে ভারতের জন্য প্রস্তুত রয়েছে মংলা।

যদিও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, ভারতকে সার্ভিস দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর প্রস্তুত। বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়ানোর কাজ চলছে। ভারতের সাথে ট্রানজিট সড়কেরও উন্নয়ন হচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্ত কোনও কাজই এখনও শেষ হয়নি। উন্নয়ন কাজ শেষ হওয়ার আগেই চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এতে উভয় দিকে সংশয় দেখা দিয়েছে বলে জানান অনেকে।

সূত্রমতে, চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি পেয়েছে ভারত। আন্তর্জাতিক অন্যান্য বন্দর ব্যবহার করলে বন্দর যেভাবে চার্জ পায়, সেভাবে সবকিছু প্রযোজ্য থাকবে। কাস্টমস ও বন্দরের যেসব চার্জ সবই দেবে ভারত।

তবে এ মুহূর্তে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রস্তুতি ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে। যন্ত্রপাতি সংকট ও কন্টেইনার রাখা, যাতায়াতের জন্য সড়ক প্রস্তুত নয়। ফলে ভারত চাইলেও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার উপযোগী না হওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে পারবে কিনা সন্দেহ করছেন ব্যবসায়ীরা।

এদিকে ভারতকে ব্যবহার করতে দিতে প্রস্তুত মংলা বন্দর। সব ধরনের সক্ষমতা রয়েছে বন্দরটির। দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মংলাকে ট্রানজিটের জন্য প্রস্তুত করতে এবং অবকাঠামো সম্প্রসারণে চার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই ভারতের ব্যবহারের জন্য উপযোগী হয়ে উঠেছে বন্দরটি। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর এখনও প্রস্তুত নয়।

ভারতকে বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়ার ব্যাপারে সরকার ইতিবাচক হলেও চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বন্দরের সূত্রগুলো বলছে, চট্টগ্রাম বন্দরের এখন যে অবস্থা তাতে নিজের দেশের ব্যবসায়ীদেরই সেবা দিতে পারছে না। এর মধ্যে ভারত যদি পণ্য আনা-নেওয়া শুরু করে তাহলে বন্দর সচল থাকবে কিনা সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্দরের অবস্থা এখনও নাজুক। প্রতিদিন সংকট বাড়লেও বাড়ছে না সক্ষমতা। বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ৩০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হলেও সে মতে কাজ হচ্ছে না। বর্তমানে চাহিদার বিপরীতে যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে তার বেশির ভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ। গত ২০১৩ সালে বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ১২০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনার কথা থাকলেও ধীরগতির কারণে এগুলো দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে পড়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে গত ২০১১ সালে জাহাজের গড় অবস্থানকাল চার দিনেরও কম ছিল। বর্তমানে তা প্রায় ছয় দিনে পৌঁছেছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দর আদৌ ভারত ব্যবহার করতে পারবে কিনা এ সংশয় দেখা দিয়েছে।

তবে বন্দর ব্যবহারের ফলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ, ভারতসহ এ অঞ্চলের মধ্যকার ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির উন্নতি ও প্রসার ঘটবে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের ব্যাপারে দু’দেশের মধ্যে কোনও চুক্তি নেই। ফলে বাংলাদেশের পরবর্তী দরজা হিসেবে পরিচিত ভারতের সাত রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের উন্নতি হয়নি। বাংলাদেশের চারপাশে থাকা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এসব রাজ্যের সঙ্গে মিয়ানমার, ভুটান ও চীনের ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ প্রসার ঘটেছে। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার তাদের জন্য অনেক বেশি সাশ্রয়ী। কারণ ভারতের ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ৬৮০ কিলোমিটার। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ২৪৮ কিলোমিটার।

একইভাবে মিজোরামের রাজধানী আইজলের সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ৫৫০ কিলোমিটার, কিন্তু সড়কপথে চট্টগ্রামের দূরত্ব মাত্র ৬৫৫ কিলোমিটার ও নদীপথে মাত্র ২৫০ কিলোমিটার। আসামের রাজধানী গৌহাটির সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব ১হাজার ৮০ কিলোমিটার, আর চট্টগ্রামের দূরত্ব ৬৭৫ কিলোমিটার। মনিপুরের রাজধানী ইমফলের সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ৫৬৫ কিলোমিটার ও চট্টগ্রামের দূরত্ব ৭৩৫ কিলোমিটার। মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ১৮০ কিলোমিটার, চট্টগ্রামের দূরত্ব ৫৭৫ কিলোমিটার। নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমার সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ৪২০ কিলোমিটার ও চট্টগ্রামের দূরত্ব ৮৮০ কিলোমিটার। এসব রাজ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য কলকাতা বন্দরকেন্দ্রিক। কিন্তু সেখানে কোনও সমুদ্র বন্দর না থাকায় দূরের পথ দিয়ে বিপুল খরচে পণ্য আমদানি-রফতানি করতে হয়। অথচ কাছেই রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। ফলে এ বন্দরের মাধ্যমে এসব রাজ্যের ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি-রফতানি করলে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ও ভারত লাভবান হবে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহাবুবুল আলম বলেন, উপযুক্ত ট্যারিফ চার্জ প্রদানের মাধ্যমে অন্য দেশ এ বন্দর ব্যবহার করবে। এতে সরকারেরই উপকার হবে। কিন্তু আগে সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যবসায়ীরা ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে দিতে অনেক আগে থেকে বলে আসছে। এতে সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোর পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো না হলে বন্দরটি ব্যবহার করা কঠিন হয়ে পড়বে। বন্দরের বে-টার্মিনাল নির্মাণসহ আধুনিক যন্ত্রপাতির যে ঘাটতি রয়েছে তা যত দ্রুত সম্ভব পূরণ করা প্রয়োজন। এছাড়া বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দিলে তা কতটুকু ফলপ্রসূ এ নিয়ে আমরাও সন্দিহান।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) এনামুল করিম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, শুরুতে ভারতের কন্টেইনার তেমন হ্যান্ডলিং করতে হবে না। ভারত বছরে হয়তো ৫ থেকে ১০ হাজার কন্টেইনার নেবে। সেটি আমাদের বন্দরের জন্য তেমন চাপ হবে না। কারণ আমরা এখন ৩০ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের রেকর্ড অর্জন করেছি। ভারত যে পরিমাণ কন্টেইনার পুরো বছরে নেবে, তা আমরা একদিনেও হ্যান্ডেলিং করি।

সক্ষমতা রয়েছে মংলা বন্দরের
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেটিতে একসঙ্গে অধিকসংখ্যক জাহাজ অবস্থান, কন্টেইনার রাখার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এবং গোডাউন, সড়কসহ অন্য সব ধরনের সক্ষমতা রয়েছে মংলা বন্দরের। ভারত এ বন্দর ব্যবহার করতে চাইলে তা দিতে প্রস্তুত মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ।

মংলা বন্দর সূত্রমতে, বন্দরে ১ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডেল করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে গড়ে ৪০ হাজার থেকে ৪২ হাজার কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং হচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের ছয়টি ও বেসরকারি সাতটি মিলে মোট ১৩টি জেটি রয়েছে। এ ছাড়া মুরিং বয়া ও অ্যাংকরেও রয়েছে জাহাজ রাখার ব্যবস্থা। সব মিলে বর্তমানে বন্দর এলাকায় একসঙ্গে ৩৫টি জাহাজ অবস্থানের সক্ষমতা রয়েছে।

মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওহিউদ্দিন চৌধুরী জানায়, গত অক্টোবরে বন্দরে দেশি-বিদেশি ৬১টি জাহাজ এসেছিল। নভেম্বরে ছিল আরও বেশি। বর্তমানে গড়ে একসঙ্গে ১৫-২০ জাহাজ অবস্থান করছে। এছাড়া বন্দর অভ্যন্তরের গোডাউনগুলোতে ৬০-৬৫ লাখ টন পরিমাণের পণ্যের ধারণক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানে যার ৫০ শতাংশও ব্যবহার হচ্ছে না।

অন্যদিকে পদ্মা সেতুকে লক্ষ্য করে বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়ানো হচ্ছে বলেও জানিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, ইতোমধ্যেই কন্টেইনার টার্মিনাল, কন্টেইনার ইয়ার্ড এবং কন্টেইনার ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণের জন্য চীনের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। যার প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া এক লাখেরও বেশি কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং ক্ষমতাসম্পন্ন আরও দুটি জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।

মংলা বন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) মোস্তাফা কামাল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, বন্দরের যে ক্যাপাসিটি রয়েছে তার মাত্র ৫০ শতাংশ এখন ব্যবহার হচ্ছে। আরও ৫০ শতাংশ অব্যবহৃত থাকছে। সুতরাং ভারত বন্দর ব্যবহার করতে চাইলে কোনো সমস্যা হবে না। তাদের ব্যবহারের সব ধরনের সক্ষমতা রয়েছে মংলা বন্দরের।

তিনি বলেন, ১২ থেকে ১৪ কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতার সাড়ে ৭ মিটার গভীরের জাহাজগুলো মংলায় ভিড়তে পারে। এখানে একটি জাহাজের গড় অবস্থান ২ থেকে আড়াই দিন। এখান থেকে ভারতের কন্টেইনারগুলো নিমিষেই হ্যান্ডলিং করা যাবে।

এছাড়াও মংলা বন্দরে কোনও কী গ্যান্ট্রি ক্রেন নেই, নতুন ইয়ার্ড তৈরির কাজ ও গ্যান্ট্রি ক্রেন ক্রয় পাইপলাইনে আছে বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, ট্রানশিপমেন্ট চুক্তির আওতায় আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকেই ভারত বাংলাদেশের এই দুটি বন্দর ব্যবহার শুরু করবে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের উন্নয়নে মালামাল পরিবহনে বাংলাদেশের বন্দর দুটি ব্যবহার করবে।

এএস/এসএ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!