ভাগ্নের বন্ধু মুহূর্তেই দানব, রোকসানার খুনির অবিকল জবানি

নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের কারণ কি শুধুই ৩০ হাজার টাকা? তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুনিকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করার পরও তিনি জানিয়েছেন, নিহত রোকসানা তার পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ। বন্ধুর মামী হওয়ার সুবাদে তিনি সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। এছাড়া স্থানীয় কাউন্সিলরের ভাগিনা হওয়ায় তাকে গুরুত্ব দেওয়া হতো।

খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী আবুল কাশেমের স্ত্রী রোকসানা বেগম মনি (৪২) হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ উঠে এসেছে একমাত্র অভিযুক্ত মো. সোহেলের (৩৫) জবানিতে। মঙ্গলবার দুপুরে টাকার জন্য পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দূরসম্পর্কীয় মামীকে খুনের পর পালিয়ে যেতে তিনি নানা কৌশল অবলম্বন করেন। তবে খুনের মাত্র নয় ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। এরপর মুখ খোলেন খুনের পরিকল্পনা, খুনের সময়কার ঘটনা ও পালিয়ে যাওয়ার কাহিনী নিয়ে।

পরিকল্পনা হয় রাতে

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় বাকলিয়া থানার ময়দার মিলের নিজ বাসা থেকে একটি ছুরি ও খেলনা পিস্তল একটি কালো ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে বের হন সোহেল। টাকার জন্য দূরসম্পর্কীয় মামা আবুল কাশেমের কোরবানীগঞ্জ বাসায় যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী কাশেম তার বন্ধুর মামা এবং তার নিজেরও পূূূূর্ব পরিচিত হওয়ায় বাসায় সবসময় টাকা-পয়সা থাকার তথ্য সোহেল জানতেন। দুপুরবেলায় শুধুমাত্র আবুল কাশেমের স্ত্রী বাসায় থাকেন সেটাও অজানা ছিল না সোহেলের। সেজন্য ছুরি ও পিস্তলের ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি করার পরিকল্পনা আঁটেন তিনি।

সোহেল এ সময় সিদ্ধান্ত নেন, ছুরি ও পিস্তলের ভয়ে যদি রোকসানা টাকা না দেন, তাহলে ‘কিছু একটা’ করে বাসায় থাকা টাকা বা মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে আসবেন তিনি। এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই সোহেল ব্যাগসহ বেলা সোয়া ১২টার দিকে তার মোটরসাইকেলে করে কোরবানীগঞ্জে রোকসানার ভাড়া বাসায় যান।

ভাগ্নের বন্ধু মুহূর্তেই দানব, রোকসানার খুনির অবিকল জবানি 1

ভাগ্নের বন্ধু মুহূর্তেই দানব

বাসায় গিয়ে আবুল কাশেমের স্ত্রী রোকসানা বেগম মনিকে দেখতে পান সোহেল। সোহেলকে দেখে রোকসানা দরজা খুলে ভেতরে বসান। এরপরই সোহেল পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রোকসানার কাছে প্রথমে ৩০ হাজার টাকা চান। রোকসানা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সোহেল ছুরি ও খেলনা পিস্তল দিয়ে ভয় দেখান। রোকসানা এ সময় বলেন, তাকে মেরে ফেললেও তিনি টাকা দিবেন না। এরপরও ভয়ভীতি দেখাতে থাকেন সোহেল। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর একপর্যায়ে সোহেল তার হাতে থাকা ধারালো ছুরি দিয়ে রোকসানাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেন। শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে থাকেন। এতে একপর্যায়ে রোকসানা নিস্তেজ হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলে তার শরীরের ওপর উঠে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত ছুরিকাঘাত করতে থাকেন সোহেল। রোকসানার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর সোহেল আলমারির মধ্যে থাকা বিভিন্ন স্বর্ণালংকার, তেলের ডিও, মোবাইল ও একটি ল্যাপটপ হাতিয়ে নেন।

বিষয়টি দেখে ফেলেন বাসার গৃহকর্মী ইয়াসমিন। তাকে ছুরির ভয় দেখিয়ে বাথরুমে আটকে রাখা হয়। এরপর হত্যার আলামত নষ্ট করার উদ্দেশ্যে বাসার রান্নাঘরের চুলার আগুনে বালিশ দিয়ে ঘরের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে দেন। যে কক্ষে রোকসানা বেগম মনির লাশ পড়ে ছিল সে কক্ষের বিছানায়ও আগুন ধরিয়ে দেন সোহেল। এ সময় রোকসানার ছোট ছেলে আব্দুল আজিজ (২৩) ঘরে ঢুকে সোহেলকে দেখতে পান। সোহেল মুহূর্তেই তাকেও পেটের বাম পাশে ছুরিকাঘাত করেন। ছুরির আঘাত সয়েও আজিজ দৌঁড়ে বাসার নিচে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন। সোহেল একহাতে ছুরি ও অপর হাতে খেলনা পিস্তল এবং লুন্ঠিত মালামাল ব্যাগের মধ্যে নিয়ে পালিয়ে যায়। পালানোর সময় পথচারী আব্দুস সোবহান (৬০) বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাকেও ছুরিকাঘাত করেন সোহেল। যাওয়ার সময় রক্তমাখা সেই ছুরি রাস্তায় ফেলে দেন খুনি সোহেল।

যেভাবে চললো আত্মগোপন

সোহলে প্রথমে খাতুনগঞ্জ আমির মার্কেট এলাকার নিউ পাক বিল্ডিংয়ে আত্মগোপন করেন। সেখানে তার পরনে থাকা গেঞ্জি, প্যান্ট , স্যান্ডেল ও খেলনা পিস্তল বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলার বাথরুমে রেখে নতুন জামাকাপড় পরে নেন। আর কালো ব্যাগটি বিল্ডিংয়ের নিচে ফেলে দেন। সন্ধ্যার পর সেখান থেকে বের হয়ে সোহেল কর্ণফুলী থানার মইজ্যার টেকের চর পাথরঘাটায় গিয়ে নতুন একটি বাসা ভাড়া নেন সোহেল। রোকসানার বাসা থেকে লুণ্ঠিত মালামাল নতুন বাসায় রেখে বাকলিয়ার ময়দার মিলে থাকা স্ত্রীকে ফোন করে নতুন বাসায় আসতে বলেন খুনি সোহেল।

এদিকে এর কিছু সময় পর কোতোয়ালী থানা পুলিশ তাকে নতুন বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে।

ভাগ্নের বন্ধু মুহূর্তেই দানব, রোকসানার খুনির অবিকল জবানি 2

ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ভাগ্নে

গ্রেপ্তার হওয়া সোহেল চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারীর ঈদপুকুরিয়া রফিক সওদাগর বাড়ির জামাল উদ্দিনের ছেলে। পেশায় ইলেকট্রিক পণ্যের ব্যবসায়ী সোহেল এক সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বাকলিয়ার ময়দার মিল এলাকার নুরুল হক হাজীর কলোনিতে ভাড়া বাসায় থাকেন। তিনি বক্সিরহাট ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাজী নুরুল হকের আপন ভাগ্নে।

স্বামী যেভাবে স্ত্রী খুনের খবর পেলেন

দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ছেলে আবু বক্কর তারেক (২৮) ও আব্দুল আজিজ (২৩) ও স্ত্রী রোকসানা বেগম মনিকে (৪২) নিয়ে কোরবানীগঞ্জ তৈলাপট্টি রোডের আমিন ম্যানশনের চতুর্থ তলায় বসবাস করছেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী আবুল কাশেম।

গম ব্যবসায়ী আবুল কাশেম প্রতিদিনের মত নিজ প্রতিষ্ঠানে চলে যান সকালে। ঘটনার দিন সোয়া একটার দিকে বাড়ির মালিক আমিন তাকে ফোন করে জানান, বাসায় দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং বাসা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। তিনি তাৎক্ষণিক খাতুনগঞ্জের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে বাসায় এসে দেখতে পান, প্রতিবেশীরা তার বাসার আগুন নেভানোর কাজ করছেন। বাসার ভিতরে ঢুকে তিনি দেখেন, তার স্ত্রী রোকসানা বেগম বেডরুমের খাটের পাশে মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। রোকসানার পেট, পিঠ, হাতসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য রক্তাক্ত কাটা জখম হয়েছে। এছাড়া সমস্ত ঘরের মালামাল এলোমেলো ও ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় পড়ে আছে। বেডরুমের খাটের দক্ষিণ অংশ ছাড়াও কিছু কাপড়চোপড় আগুনে পুড়ে গেছে। রান্নাঘরে বালিশের আগুনে পোড়া অংশ মেঝেতে পড়ে আছে। এরপর তিনি জানতে পারেন তার ছোট ছেলে আব্দুল আজিজ ওই খুনির ছুরিকাঘাতে পেটের বাম পাশে গুরুতর আহত হলে প্রতিবেশীরা তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।

খুনের কারণ কি শুধুই টাকা?

নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের কারণ কি শুধুই ৩০ হাজার টাকা? তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুনিকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করার পরও তিনি জানিয়েছেন, নিহত রোকসানা তার পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ। বন্ধুর মামী হওয়ার সুবাদে তিনি সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। এছাড়া স্থানীয় কাউন্সিলরের ভাগিনা হওয়ায় তাকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু তিন মাস আগে নিজের ইলেকট্রিক পণ্যের দোকানটি বিক্রি করে দিতে হয় নানা কারণে। এ নিয়ে নিজের মধ্যে হতাশা কাজ করতো সোহেলের। ধার দেনা কাটাতে নানা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে মাঝেমধ্যে নেশাও করতেন সোহেল। ওই দিন ৩০ হাজার টাকার জন্যই মূলত নিহত রেকসানার বাসায় যান। তবে টাকা সহজে না দিলে ভয় দেখিয়ে আদায় করারও পরিকল্পনা ছিল। তবে ভয়েও কাজ না হওয়ায় ছুরিকাঘাত করে খুন করে চোখের সামনে যা পেয়েছেন তা লুটপাট করেছেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!