বড় জালিয়াতি করে ছোট শাস্তি পেলেন চবি শিক্ষক সুপ্তিকণা

চবি সিন্ডিকেটের হঠাৎ সিদ্ধান্তে শিক্ষকরাও অবাক

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় খাতা জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর বরখাস্ত হওয়া সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক সুপ্তিকণা মজুমদারকে ফের চাকরিতে বহাল করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট। এক্ষেত্রে তিনি এক বছর পরীক্ষা সংক্রান্ত কোন কাজে অংশ নিতে পারবেন না।

সাত বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) সিন্ডিকেট হঠাৎ করেই এমন সিদ্ধান্তে এসেছে। শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) চারুকলা ইনস্টিটিউটে সিন্ডিকেটের ৫২৬তম সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পরপরই বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) অধ্যাপক সুপ্তিকণা মজুমদার আবার বিভাগে যোগও দিয়েছেন।

বিষয়টি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে নিশ্চিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর এস এম মনিরুল হাসান বলেন, ‘এটা সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত। সিন্ডিকেট মনে করেছে তার শাস্তি অতিরিক্ত হয়েছে। তাই চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়েছে। তিনি আজ যোগদানও করেছেন।’

জানা গেছে, ২০১৩ সালের তৃতীয় বর্ষ (সম্মান) পরীক্ষার ৩০৮ নং কোর্সের (প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি) পরীক্ষার কাজে দায়িত্বে অবহেলা, অনিয়ম, দুর্নীতি এবং পরীক্ষার খাতা জালিয়াতির অভিযোগ তুলে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য বরাবর আবেদন করেন ওই বিভাগের তৎকালীন প্রভাষক (বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক) লিটন মিত্র। ২০১৪ সালের ৮ মার্চ দেওয়া এই অভিযোগ তদন্তে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফ উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. এম আবদুল গফুরকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটিতে ফলিত ও পরিবেশ রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দীন আহমেদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক খালেদ মিছবাহুল মোকর রবীনকে সদস্য করা হয়।

তদন্ত শেষে কমিটি লিটন মিত্রের আনা অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পায়। পরীক্ষা সংক্রান্ত জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ায় প্রফেসর ড. সুপ্তিকণা মজুমদারকে শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করে ওই কমিটি।

পরে এ ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটিতে মার্কেটিং বিভাগের প্রফেসর এস এম সালামত উল্ল্যা ভূঁইয়াকে সভাপতি করা হয়। সদস্য করা হয় মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ইসকান্দর মো. রেশাদুল করিমকে।

এই তদন্ত কমিটিও প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, পছন্দের শিক্ষার্থীকে হলের বাইরে নিয়ে গিয়ে অতিরিক্ত উত্তরপত্রে লেখার সুযোগ করে দিয়েছেন সুপ্তিকণা মজুমদার।

এদিকে প্রথম তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অন্যায়ভাবে অতিরিক্ত খাতা যুক্ত করার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যকে অবহিত করেন লিটন মিত্র। উপাচার্যের মৌখিক নির্দেশে উত্তরপত্র পরীক্ষণ শেষে কভার পেইজের ফটোকপি করে রাখেন বলেও লিটন মিত্র তদন্ত কমিটিকে জানান। তদন্তের স্বার্থে কমিটি ওই পরীক্ষার উত্তরপত্রগুলো পরীক্ষা কমিটির সভাপতি সুপ্তিকণা মজুমদারের কাছ থেকে সংগ্রহ করে। তবে সেখানে ১২২০৩৬ নম্বর অতিরিক্ত খাতাটি তিনি কমিটির কাছে সরবরাহ করেননি সুপ্তিকণা।

তদন্তে দেখা গেছে, লিটন মিত্রের দেওয়া ফটোকপির সঙ্গে সুপ্তিকণার দেওয়া মূল খাতাগুলো মিলিয়ে দেখে কমিটি। সেখানে দেখা গেছে, লিটন মিত্রের জমা দেওয়া ফটোকপিতে ১২২০৩২, ১২২০৩৪, ১২২০৩৬ নং খাতায় কারও স্বাক্ষর নেই। কিন্তু ১২২০৩২ ও ১২২০৩৪ নম্বর মূল অতিরিক্ত উত্তরপত্রে ওই বিভাগের শিক্ষক শিপক দেবনাথের স্বাক্ষর রয়েছে। ১২২০৩৬ নং খাতায় কারও স্বাক্ষর নেই। যেটিতে কারো স্বাক্ষর নেই, সে খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় লিখে আবার কেটে দেওয়া হয়েছে বিধায়, এই খাতাটি পরীক্ষা কমিটির সভাপতি সুপ্তিকণা তদন্ত কমিটির কাছে জমা দেননি। কিন্তু লিটন মিত্রের ফটোকপিতে ওই খাতার অস্তিত্ব খুঁজে পায় তদন্ত কমিটি।

পরবর্তীতে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ৫২০ তম সভার ৩ (ঘ) সিদ্ধান্তে উপাচার্যকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ ব্যাপারে সুপ্তিকণার কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। পরবর্তীতে ৭ মার্চ তিনি ব্যাখ্যা প্রদান করেন।

এ অবস্থায় ৫২০ তম সভার ৩ (ঘ) সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আনীত অভিযোগ তদন্তে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী (দক্ষতা ও শৃঙ্খলা) সংবিধির ৪(১) ধারা অনুসারে প্রফেসর সুপ্তিকণাকে গত বছরের ১২ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে বরখাস্ত (ডিসমিস) করা হয়।

এরপরই শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) সিন্ডিকেটের ৫২৬তম সভায় সুপ্তিকণার শাস্তি ‘মওকুফ’ করার পর বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) অধ্যাপক সুপ্তিকণা মজুমদার আবার কাজেও যোগ দিয়েছেন।

অভিযোগকারী শিক্ষক লিটন মিত্র চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘আমি এই সংবাদটা শুনে স্তম্ভিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন সিদ্ধান্তে অন্য শিক্ষকদের অনৈতিক কাজে উদ্বুদ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস।’

এমআইটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!