‘বড় ঋষির সমর্থকরাই হামলা চালায়’

বাঘাইছড়ি হত্যাকান্ডের তদন্ত প্রতিবেদন

বাঘাইছড়িতে ব্রাশফায়ারে ৮ খুনের বহুল আলোচিত ঘটনার জন্য নির্বাচন বর্জনকারী চেয়ারম্যান প্রার্থী জেএসএসের (সন্তু লারমা) বড় ঋষি চাকমা ও তার সমর্থক অস্ত্রধারীদের দায়ী করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠিত সাত সদস্যের তদন্ত কমিটির জমা দেওয়া প্রতিবেদনে ঘটনার বেশ কটি ‘কারণ’ উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগই নির্বাচন সংশ্লিষ্ট। ভবিষ্যতে এ ধরনের হামলা এড়াতে বেশ কিছু সুপারিশও তৈরি করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ও রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘বাঘাইছড়ি হত্যাকাণ্ড নির্বাচন সংশ্লিষ্ট। যারা নির্বাচন বর্জন করেছে তারাই ওই ঘটনা ঘটিয়েছে।’

গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আব্দুল মান্নানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। চলতি সপ্তাহে এই প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পৌঁছাবে। তারপরই করণীয় ঠিক করবে সরকার।

বড় ঋষি চাকমা পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন জনসংহতি সমিতির (সন্তু লারমা) বাঘাইছড়ি উপজেলার সাধারণ সম্পাদক। তিনি এর আগেও জেএসএস’র সমর্থন নিয়ে বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং এবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। তার প্রতীক ছিলো দোয়াত কলম। কিন্তু ১৮ মার্চ ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর পর অনিয়মের অভিযোগ এনে বড় ঋষি চাকমা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্কারপন্থী জেএসএস গ্রুপের সদস্য (এমএন লারমা) সুদর্শন চাকমা ওই নির্বাচনে বিজয়ী হন। আগামী ২৫ এপ্রিল শপথ গ্রহণের পরই তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।

গত ১৮ মার্চ বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন শেষে সন্ধ্যায় তিনটি কেন্দ্রের সরঞ্জাম নিয়ে বাঘাইছড়ি সদরে ফেরার সময় ৯ কিলো নামক স্থানে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে সাতজন ও পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো একজন মারা যায়। আহত হন অন্তত ৪০ জন। ওই হামলার পরের দিন গত ১৯ মার্চ চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) দীপক চক্রবর্তীকে প্রধান করে সাত সদস্যের এ কমিটি গঠন করা হয়।

প্রতিবেদনে হামলার কারণ

প্রতিবেদনে হামলার সম্ভাব্য কারণের মধ্যে কেন্দ্রের গাড়িতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জেএসএস (এমএন লারমার) সুদর্শন চাকমার এজেন্ট ও কর্মী থাকার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের উপস্থিতির কারণে গাড়িগুলো হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। মূলত ‘নির্বাচনী বিরোধ’ই এই হামলার অন্যতম কারণ বলে কমিটি মনে করছে।

সুদর্শন চাকমা ঘোড়া প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হন। তাকে আওয়ামী লীগ সমর্থন দিয়েছিল। ভোটগ্রহণ শেষে কেন্দ্র থেকে ফেরার সময় ঘোড়া প্রতীকের কর্মী কেন্দ্রের গাড়িতে ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মন্টু চাকমা নামের এক কর্মী গুলিতে মারা যাওয়া ও স্ট্রং চাকমা নামের অপর একজন আহত হওয়ায় এ অভিযোগের সত্যতাও মেলে। বাঘাইহাট থেকে তিনটি কেন্দ্রের গাড়ি রওনা দেওয়ার সময় আরেকটি চাঁদের গাড়িতে ঘোড়া প্রতীকের লোকজন ছিল বলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন। মাঝপথে ওই গাড়ি দীঘিনালার দিকে চলে যায়।

তদন্ত কমিটির সুপারিশ

তদন্ত প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে পাহাড়ের সঙ্গে ভারতের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার, পাহাড়ি তিন জেলায় একসঙ্গে যৌথবাহিনীর অভিযান পরিচালনা, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও হতাহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ প্রদান উল্লেখযোগ্য। এছাড়া গুলিবর্ষণের মুখেও তিনটি চাঁদের গাড়ির চালকেরা সাহসিকতা দেখিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে আসার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিয়েছে কমিটি। যদিও ওভাবে না আসত, তাহলে আরো বেশি প্রাণহানির আশঙ্কা ছিল। এ কারণে চালকদেরও পুরস্কৃত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, ‘হামলার উদ্দেশ্য চিহ্নিত করতে পেরেছে তদন্ত কমিটি। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতেও বেশকিছু সুপারিশ তৈরি করেছে কমিটি।’ তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে হামলায় আহত, স্থানীয় জনগণ, জনপ্রতিনিধি, রিটার্নিং কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গেই কথা বলেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন বর্জন করে বড় ঋষি চাকমার সমর্থকরাই পূর্বপরিকল্পিত এ হামলা চালিয়েছে’।

তবে এ বিষয়ে কথা বলতে বড় ঋষি চাকমার মুঠোফোনে শুক্রবার একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজন জানান, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের পর থেকেই তিনি পলাতক রয়েছেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!