ব্যাংকের টাকা মিলেমিশে লুটপাটে চট্টগ্রামের তিন ভাই, দেশ ছাড়তে মানা এবার

পরিবারের প্রায় সব সদস্যই কানাডার বেগমপাড়ায়

গত বছরের নভেম্বরে চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বাগদাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান ফেরদৌস খান আলমগীরকে ১৫ মাসের আটকাদেশ দেওয়ার পর এবার ওই গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ তানভীর খান এবং মোহাম্মদ আজাদ খানকে এবার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালত। সম্পর্কে তারা তিন ভাই।

৩৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দীর্ঘদিনেও সেই টাকা পরিশোধ না করায় ঢাকা ব্যাংকের দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার (৩০ মার্চ) চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের যুগ্ম জেলা জজ মুজাহিদুর রহমান এই আদেশ দিয়েছেন। দেশত্যাগে এই নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি আদেশের কপি অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ছাড়াও পুলিশের বিশেষ শাখায় পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

শুধু চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতেই বাগদাদ গ্রুপের এই মালিকদের বিরুদ্ধে ৫০০ কোটিরও বেশি টাকা আদায়ের লক্ষ্যে অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে প্রায় একযুগ ধরে।

পর্যবেক্ষণে আদালত জানিয়েছেন, আসামিদের পরিবারের অধিকাংশ সদস্য বিদেশে অবস্থান করছেন। এই অবস্থায় তারা দেশত্যাগ করলে জনগণের আমানতের টাকা আদায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। কারণ বাংলাদেশ থেকে অনেক ঋণখেলাপিই অর্থ পাচার করে কানাডার কথিত বেগমপাড়ায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন বলে জানা গেছে।

এর আগে গত বছরের ১৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান ১৫ মাসের আটকাদেশ দেন চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বাগদাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান ফেরদৌস খান আলমগীরকে। ঋণখেলাপের মামলায় ঢাকা ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকসহ তিনটি ব্যাংকের আবেদনের ওপর শুনানি শেষে ওই আটকাদেশ দেন আদালত।

বিচারক সেই আদেশে উল্লেখ করেন, সব ব্যাংকের কারাভোগ একসাথে না খেটে এক ব্যাংকের সাজা খাটার পর আরেকটির শুরু হবে।

ফেরদৌস খান আলমগীরের কাছে সিটি ব্যাংকের পাওনা ৩১ কোটি ৫৬ লাখ ১৩৬২ টাকা। ঋণ নিয়ে দীর্ঘ সময়েও সেটা পরিশোধ না করায় পরে ব্যাংকের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হয়। এরপর ২০১২ সালের জারি মামলা করা হয়। চলতি বছরের অক্টোবরে অর্থঋণ আদালতে আবেদন করা হলে আলমগীরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। এরপর ৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর লালদীঘির পাড় এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওইদিনই তাকে আদালতে হাজির করা হলে বিচারক কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন তাকে।

ঋণ নিতেই খোলা হয় কোম্পানি

ফেরদৌস খান আলমগীর তার দুই সহোদর তানভীর খান আলমগীর ও আজাদ খান আলমগীরসহ মিলে মৎস্য আহরণ, আবাসন, পরিবহনসহ আরও কয়েকটি ব্যবসার জন্য মেসার্স আলমগীর ব্রাদার্স, বাগদাদ ট্রেডিং, ফেরদৌস এন্টারপ্রাইজ, বাগদাদ এক্সিম করপোরেশন, বাগদাদ পরিবহন ও বাগদাদ প্রপার্টিজ নামে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন। এসব কোম্পানির নামে ব্যবসা পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা আর পরিশোধ করা হয় না। এভাবেই চলছে যুগের পর যুগ।

রাউজানের বাসিন্দা, থাকেন খুলশীতে

চট্টগ্রামের রাউজানের বাসিন্দা ফেরদৌস খান আলমগীরের পৈত্রিক বাড়ি নগরীর খুলশী এলাকার জাকির হোসেন সড়কে। আলমগীর ফেরদৌস এন্টারপ্রাইজের চেয়ারম্যান। ছিলেন ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পরিচালক। বেসরকারি সাদার্ন ইউনিভার্সিটির পরিচালক হিসেবে নাম রয়েছে তার।

প্রতারণার জাল একের পর এক

বাগদাদ গ্রুপের চেয়ারম্যান ফেরদৌস খান আলমগীর ও তার বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাংকের অন্তত এক ডজন মামলা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— ঢাকা ব্যাংকের চেক প্রতারণার অভিযোগে ১৬ কোটি টাকার মামলা, সিটি ব্যাংকের ৩২ কোটি টাকা এবং চেক প্রতারণার অভিযোগে ১৪ কোটি টাকার এসটি মামলা, ব্যাংক এশিয়ার ২২ কোটি টাকা ও ইস্টার্ন ব্যাংকের ১৫ কোটি টাকা এবং চেক প্রতারণার অভিযোগে ৭৯ লাখ টাকার মামলা, এক কোটি টাকার চেক প্রতারণার মামলাসহ আরও বিভিন্ন মামলা।

আলগমগীরের প্রতিষ্ঠান বাগদাদ ট্রেডিংয়ের কাছে রূপালী ব্যাংক পাবে ৪৫ কোটি ৬৮ লাখ ৭৪ হাজার ৮৫ টাকা। সেই টাকা ফেরত চেয়ে মামলার আট বছর পার হওয়ার পর রূপালী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা ২০১০ সালে বাগদাদ গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করে। সেই মামলায় ফেরদৌস খান আলমগীরসহ তার দুই ভাই তানভীর খান আলমগীর ও আজাদ খান আলমগীরকে আসামি করা হয়।

এছাড়া বাগদাদ গ্রুপ ও এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের কাছে ইসলামী ব্যাংক পাবে ৫৫ কোটি টাকা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকও পাবে ১৫ কোটি টাকা।

সাজানো আগুনেও টাকা হাতানোর কৌশল

চলতি বছরের ১১ মার্চ চট্টগ্রাম নগরীর আকবরশাহ সিডিএ আবাসিক এলাকায় বাগদাদ এক্সপ্রেসের একটি ডিপোতে রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডে ৯টি মার্সিডিজ বাস পুড়ে যায়। এস আলম গ্রুপ থেকে কেনা প্রায় জরাজীর্ণ এই ৯টি বাস ছাড়াও সেখানে থাকা আরও দুটি বাসের সবগুলোই ছিল অচল। এই ‘অগ্নিকাণ্ড’ও সাজানো বলে তখন বিভিন্ন মহল থেকে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। খেলাপি ঋণের টাকা শোধ না করা ও বীমার টাকা আদায় করতে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটানো হয়— এমন অভিযোগ ওঠে তখনই।

পরিবহন ব্যবসায় কথিত বিনিয়োগের নামে বাগদাদ এক্সপ্রেস দফায় দফায় ঋণ নেয় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের প্রবর্তক মোড় শাখা থেকে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে এখন ব্যাংকটির পাওনা দাঁড়িয়েছে ৩৩ কোটি ৫৭ লাখ ৩৬ হাজার ৭৪৫ টাকা। যার মধ্যে রয়েছে বাই মোরাবাহা (হাইপো) বিনিয়োগের বিপরীতে ১৪ কোটি ৪৬ লাখ ৮৭ হাজার ৮৪৯ টাকা ও এইচপিএসএম (পরিবহন) বিনিয়োগের বিপরীতে ১৯ কোটি ১০ লাখ ৪৮ হাজার ৮৯৬ টাকা। এ পাওনা আদায়ে ঋণের বিপরীতে বন্ধকীতে থাকা সীতাকুণ্ড উপজেলা জঙ্গল সলিমপুরের ৬০ ডেসিমেল জমি গত ফেব্রুয়ারিতে নিলামে তুলেও বিক্রিতে ব্যর্থ হয় ব্যাংকটি।

ঋণের টাকা গেছে কানাডায়

৩০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাগদাদ গ্রুপের কর্ণধার ফেরদৌস খান আলমগীরের প্রায় পুরো পরিবারই কানাডাপ্রবাসী দীর্ঘদিন ধরে। তার ভাই আরেক ঋণখেলাপি তানভীর খান আলমগীরও পাকাপাকিভাবে কানাডায় বসবাস করছেন।

বউও একই কাজের কাজী

এর আগে ২০১৯ সালের ১৯ আগস্ট ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বাগদাদ গ্রুপের কর্ণধার ফেরদৌস খান আলমগীরের স্ত্রী মেহেরুন নেছাকে। তিনি নগরের ফিরিঙ্গিবাজারের নবী দোভাষের মেয়ে। মেহেরুনের চাচা জহিরুল আলম দোভাষ এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান। গ্রেপ্তারের পর ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে চট্টগ্রামের খুলশী থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। মেহেরুন নেছার বিরুদ্ধেও চেক প্রতারণা ও খেলাপি ঋণের ১৫ মামলা ছিল আগেই। নয় মামলায় সাজাও হয় তার। বেখেয়ালে কানাডা থেকে দেশে ফিরতেই বিমানবন্দরে হাতকড়া পড়ে। বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের চেক প্রতারণার নয় মামলায় ইতিমধ্যে মেহেরুন নেছার সাজা হয়েছে। এছাড়া একই প্রতিষ্ঠানের আরও ছয় মামলায় তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা রয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে চেক প্রতারণার মামলা ১৩টি এবং অর্থঋণ মামলা দুটি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে কানাডায় বসবাস করার কারণে তার নাগাল মিলছিল না।

তবে চেক প্রতারণা ও ঋণখেলাপি মামলায় গ্রেপ্তারের মাত্র দুদিন পরই চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন মেহেরুন নেছা।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!