বেহাত ল্যাপটপসহ আটক নির্বাচনকর্মীর পেনড্রাইভে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য!

পাঁচদিনের রিমান্ডে মোস্তফা ফারুক

নির্বাচন কমিশনের চুরি যাওয়া ল্যাপটপসহ এবার আটক হলেন মোস্তফা ফারুক নামে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজে যুক্ত এক কর্মী। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম (সিটি) ইউনিট তাকে বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) আটক করে। মোস্তফা ফারুক (৩৬) ফেনী জেলা সদরের লস্করহাট দমদমা এলাকার মোহাম্মদ ইলিয়াছের ছেলে। বর্তমানে নগরীর হামজারবাগের মোমিনবাগ আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন।

এদিকে জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতির মামলায় মোস্তফা ফারুককে পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আবু সালেম মোহাম্মদ নোমানের আদালত।

তিন দিন আগে রোহিঙ্গাদের ভোটার আইডি ও জাতীয় পরিচয়পত্র সরবরাহ করার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নির্বাচন কমিশনের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনসহ (৩৫) তিনজনকে আটক করা হয়।

ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে কর্মরত মোস্তফা ফারুক এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত বলে শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মো. শহীদুল্লাহ। মোস্তফা ফারুকের কাছ থেকে দুটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে একটি নির্বাচন কমিশনের চুরি যাওয়া ল্যাপটপ। তবে দুটিই ল্যাপটপই ফরম্যাট দেওয়া। এর ফলে সেখান থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যাবে কিনা—তা নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। তবে তার কাছ থেকে জব্দ করা দুটি পেনড্রাইভে রোহিঙ্গাদের তথ্য এবং নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের একটি মডেম, আইডি কার্ড লেমিনেটিং করার ৫০টি কাগজ, তিনটি সিগনেটার প্যাড ও মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে তার কাছ থেকে।

যেভাবে আটক মোস্তফা ফারুক
১৬ সেপ্টেম্বর এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় গ্রেপ্তার চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মোস্তফা সম্পর্কে তথ্য পায় নগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) এর ভিত্তিতে মোস্তফা ফারুককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কাউন্টার টেররিজম ইউনিট কার্যালয়ে তাকে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এনআইডি জালিয়াতির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় মোস্তফা ফারুককে। পরে তার বাসায় তল্লাশি চালিয়ে দুটি ল্যাপটপ পাওয়া গেছে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এর মধ্যে একটি কমিশন থেকে চুরি যাওয়া ল্যাপটপ।

বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের অধীনে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে কাজ করেন মোস্তফা ফারুক।
বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের অধীনে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে কাজ করেন মোস্তফা ফারুক।

৫ বছর ধরে নির্বাচনী কাজে
মোস্তফা ফারুক কোতোয়ালী থানা নির্বাচন অফিসের অধীনে ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অস্থায়ী কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। তার কর্মকাণ্ডে সন্দেহ তৈরি হলে তাকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেন তৎকালীন থানা নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ শেখ। তবে অস্থায়ী ওই চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও চট্টগ্রাম নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে মোস্তফা ফারুকের আনাগোনা ছিল। ২০১৯ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু হলে মোস্তফা ফারুককে আবারও বিভিন্ন উপজেলায় টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। গত জুন থেকে চলতি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোস্তফা ফারুক কর্ণফুলী, আনোয়ারা, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও বোয়ালখালী উপজেলায় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কাজ করেছেন। সর্বশেষ তিনি বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের অধীনে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে টেকনিক্যাল সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে কাজ করেন।

মূল সূত্র জয়নাল
গত ১৬ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গাদের ভোটার আইডি ও জাতীয় পরিচয়পত্র সরবরাহ করার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নির্বাচন কমিশনের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনসহ (৩৫) তিনজনকে আটক করা হয়। রোহিঙ্গাদের ভোটার করা ও জাতীয় পরিচয়পত্র পাইয়ে দেওয়ার কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীনসহ ওই তিনজনকে আটক করে পুলিশ। তারা নির্বাচন কমিশনের লাইসেন্স করা ল্যাপটপ ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের এনআইডি তৈরি ও জাতীয় তথ্যভাণ্ডারে তথ্য আপলোড করতেন।

আটক ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক জয়নালের বাড়ি বাঁশখালী। অন্য দুজন হলেন পটিয়া উপজেলার মৃত হারাধন দাসের ছেলে পেশায় গাড়িচালক বিজয় দাস (২৬) ও তার বোন সীমা দাস (২৪)। সীমা চট্টগ্রাম সরকারি জেনারেল হাসপাতালের অস্থায়ী আয়া হিসেবে কর্মরত।

জালিয়াতির নিখুঁত চক্র
নির্বাচন কমিশন চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন ২ দিনের জন্য কোতোয়ালী থানার দেওয়ানবাজার সাব এরিয়া এলাকার আমেনা মঞ্জিলের ষষ্ঠ তলার একটি ফ্ল্যাটেই অফিসকে নিয়ে আসতেন। সেই ফ্ল্যাটে নির্বাচন কমিশনের অফিস থেকে ডিএসএলআর ক্যামেরা, ফিঙ্গার প্রিন্ট স্ক্যানার, সিগনেচার প্যাডও আনতেন। সপ্তাহের সরকারি বন্ধের ২ দিন শুক্রবার ও শনিবারসহ বন্ধের দিনগুলোতে নিজ ফ্ল্যাটে বসে জাতীয় পরিচয়পত্রের যাবতীয় প্রাথমিক কার্যক্রম (ডাটা ক্রিয়েট) সম্পন্ন করতেন।

জয়নাল এই দায়িত্ব পালন শেষে সব তথ্য ঢাকার নির্বাচন কমিশন অফিসের এনআইডি শাখায় কর্মরত সাগরের কাছে মেইলে পাঠিয়ে দিতেন। তারপর অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে নির্বাচন কমিশনের ব্যবহৃত ল্যাপটপ সংগ্রহ করে নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে তথ্য আপলোডসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করতেন সাগর। এরপর জাতীয় পরিচয় পত্রের প্রিন্ট কপি এসএ পরিবহনের (কুরিয়ার) মাধ্যমে চট্টগ্রামে জয়নালের কাছে পাঠাতেন সাগর।

আর গ্রাহক সংগ্রহ ও পৌঁছে দেওয়ার কাজটি করতেন সত্য সুন্দর দে, বিজয় দাশ ও সীমা দাশ। তারা চট্টগ্রাম, ঢাকা, কক্সবাজারের বিভিন্ন লোকজনের মাধ্যমে দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করে প্রত্যেকটি এনআইডি কার্ডের জন্য ৫০-৬০ হাজার টাকা আদায় করতেন।

১৬ সেপ্টেম্বর কোতোয়ালী থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক জয়নাল, গাড়িচালক বিজয় দাস ও তার বোন সীমা দাসকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন।

এ ঘটনায় ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের রেজিস্ট্রেশন অফিসার পল্লবী চাকমা পাঁচজনকে আসামি করে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন ও ডিজিটাল আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।

আরওয়াই/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!