বেপরোয়া গতি/ চট্টগ্রামের সড়কে মৃত্যুর ফাঁদ, প্রতিদিন যাচ্ছে ৬ জনের প্রাণ

সড়কে থামছেই না মৃত্যুর মিছিল। দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে যাচ্ছে শিশু-তরুণ-বৃদ্ধার প্রাণ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গড়ে প্রতিদিন শহরে প্রাণ হারাচ্ছে ৬ জন মানুষ।

চমেক হাসপাতালের পরিসংখ্যান অনুসারে, চট্টগ্রাম মহানগরে এ বছর জানুয়ারিতে সড়কে প্রাণ হারিয়েছে ৬৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৩ জন, মার্চ মাসে ৩৫ জন এবং এপ্রিলে ৪৭ জন।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের দেশব্যাপী নজিরবিহীন আন্দোলনেও গণপরিবহনে ফেরেনি শৃঙ্খলা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সড়ক নিরাপত্তা আইন ২০১৮ সংসদে পাস হলেও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর প্রতিযোগিতা বরং তাতে আরও বাড়ছে। সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) অভিযানের পরও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় তেমন প্রভাব পড়েনি। অভিযানকালে অধিকাংশ মালিক ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন সড়কে নামান না। তবে অভিযান শেষে আবারও সড়কে চষে বেড়ায় এসব যানবাহন। সড়কে বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানোর কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনা।

অবৈধ, ফিটনেসবিহীন ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ মার্চ মাসে সর্বমোট ১ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার ৩০০ টাকা জরিমানা আদায় করেছে। এ সময় ৩৩ হাজার ৯৭টি যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে ৩ হাজার ১২৫টি যানবাহন। এপ্রিল মাসে ১৪ হাজার ১০টি মামলা নিষ্পত্তি থেকে জরিমানা আদায় হয়েছে ৪৮ লাখ ৮৪ হাজার ৭৫০ টাকা। উল্লেখ্য, এপ্রিল মাসে মোট মামলা হয়েছে ১৫ হাজার ১৪৮ টি যানবাহনের বিরুদ্ধে ।
অবৈধ, ফিটনেস বিহীন ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের জন্য প্রতিমাসে মামলা আদায় করা হলেও কোথাও বেপরোয়া গতির জন্য মামলা দেয়া হয় না। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম ডিসি ট্রাফিক (উত্তর) হারুনুর রশীদ হাযারী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, চালক কত স্পিডে গাড়ি চালায় তার রেগুলেটর ঢাকায় থাকলেও আমাদের নেই। ওই উন্নত প্রযুক্তি আমাদের হাতে এখনো আসেনি, তবে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

বিআরটিএ পরিবহন কর্মকর্তাবৃন্দ জানান, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর সাথে সাথে সরকারের নীতিনির্ধারকদের এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে ধর্মঘটের ডাক দেয় পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো। তাই জাতীয় স্বার্থে সড়ক দুর্ঘটনা কীভাবে কমিয়ে আনা যায় এই লক্ষ্যে সরকারকে কাজ করতে হবে। এছাড়া কোনোভাবেই যেন হেলপার কিংবা অদক্ষ কাউকে লাইসেন্স না দেওয়া হয়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞদের অভিমত, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে মাঝে মাঝে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। এছাড়া অধিকাংশ যানবাহনের চালক প্রশিক্ষিত না। অনেকের আবার লাইসেন্সও নেই। পুলিশকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে সড়কে এসব ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলে-এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। ইতোমধ্যে বিভিন্ন জরিপেও এসেছে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হলো যানবাহনের বেপরোয়া গতি। বেপরোয়া গতির পাশাপাশি চালকের অদক্ষতা, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন না মানা, ওভারটেকিং করা, গুরুত্বপূর্ণ সড়কে জেব্রা ক্রসিং না থাকা, চলন্ত অবস্থায় চালকের মোবাইল ফোনে কথা বলা, রাস্তার নির্মাণ ত্রুটি, ফুটপাত দখল এবং যাত্রীদের অসতর্কতাও অনেকাংশে এ ক্ষেত্রে দায়ী।

বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে বর্তমানে যানবাহন আছে ৩৫ লাখ ৪২ হাজার। মোটরযান আইন অনুযায়ী-চাকা, ইঞ্জিন ক্ষমতা ও ধরণ বিবেচনায় নিয়ে ৪০ ধরনের যানের নিবন্ধন দেয় বিআরটিএ। প্রসঙ্গত সারাদেশে মোটরসাইকেল আছে ২২ লাখ ৪০ হাজার। কারসহ অবাণিজ্যিক যানবাহনের ক্ষেত্রে তৈরির সাল থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের ফিটনেস সনদ একসঙ্গে দেওয়া হয়। বাস, ট্রাকসহ যানবাহনের ফিটনেস সনদ নিতে হয় প্রতি বছর।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের (আঞ্চলিক কমিটি) সভাপতি মোহাম্মদ মুছা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে মালিকদেরকেও সচেতন হতে হবে। তারা চালকদের দৈনিক চুক্তিতে গাড়ি চালাতে দেন। এতে চালকরা অনেক বেশি যাত্রীর আশায় যে রুটে চলাচলের কথা সে রুটে চালায় না। নগরীতে ১৭টি রুট আছে। এসব রুটে যাত্রী থাকুক আর না থাকুক চালকদের নির্দিষ্ট গন্তব্য পর্যন্ত গাড়ি চালাতে হবে। অনেক সময় চালকরা অর্ধেক পথে যাত্রী নামিয়ে দেয়। এই বিষয়গুলো ট্রাফিক পুলিশকেও খেয়াল রাখতে হবে। রাস্তায় যানবাহনের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়া গাড়ি কোথায় দাঁড়াবে তা সিটি কর্পোরেশনকে মার্কিং করে দিতে হবে। যত্রতত্র গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠালে চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশ সেই দায়িত্বটি পালন করে না। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি আমাদেরও কাম্য নয়। আমার মতে, ট্রাফিক ও চালক উভয়পক্ষকে সংশোধন হতে হবে।

এ বিষয়ে ডিসি ট্রাফিক (উত্তর) হারুনুর রশীদ হাযারী আরও জানান, আমরা প্রতিটি বাস স্টপেজের মোড়ে নির্দেশক লাগিয়ে দিয়েছি। সার্বক্ষণিক ট্রাফিক বিভাগের নজরদারীতে থাকছে পুরো শহর তবুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সামলে নিতে হিমশিম খাচ্ছি আমরা ।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলার এয়ারপোর্ট রোডে বাস চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে নামে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বেপরোয়া গতিতে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারাত্মক আহত বা নিহত হলে চালকের সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানার বিধান রেখে গত ৬ আগস্ট সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় সরকার।

এসআর/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!