বৃহত্তর চট্টগ্রামে দুই মাসে সাতজনের ‘ক্রসফায়ার’, সারা দেশে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ১৫টি

গত এক মাসে সারা দেশে কথিত ক্রসফায়ারের ঘটনায় চার জন নিহত হয়েছেন। এই চারজনই বৃহত্তর চট্টগ্রামের কক্সবাজারের বাসিন্দা। সারা দেশে সবমিলিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে ৮টি। অন্যদিকে কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে পাঁচটি। এর আগে আগস্ট মাসে সারাদেশে কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে সাতটি। এসব ঘটনায় মারা গেছেন পাঁচ জন। এর মধ্যে তিনজনই বৃহত্তর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও কক্সবাজারের বাসিন্দা। কথিত ক্রসফায়ারের ঘটনায় আরও একজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক হয়েছেন। একটি ঘটনায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নদীতে তলিয়ে গেছেন অপর একজন। তিনি টেকনাফের বাসিন্দা।

আগস্ট ও সেপ্টেম্বর— দুই মাসের এই মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফের সংগ্রহ করা তথ্য অনুযায়ী এ পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাসের প্রথম দিনেই বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী দৌছড়ির ছাগলখাইয়া এলাকার সেনাবাহিনী ও বিজিবির যৌথ অভিযানে জেএসএস সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে গোলাগুলি হয়। ওই ঘটনায় জেএসএস গ্রুপের বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন।

৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার খাগডহর এলাকায় র‌্যাবের সঙ্গে জঙ্গিদের গোলাগুলির পর অস্ত্রসহ চার জঙ্গিকে আটক করা হয়। ১২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মো. শাহজাহান (২৭) ও অজ্ঞাতনামা আরও একজন নিহত হন। ১৬ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর হাতিয়ায় নিঝুম দ্বীপের সিডিএসপি বাজারের কাছে জলদস্যু হাসান বাহিনীর সঙ্গে কোস্টগার্ড সদস্যদের গোলাগুলি হয়। এ সময় হাসান বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ হাসানকে অস্ত্র ও গুলিসহ আটক করা হয়।

২২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের উখিয়ায় র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ জাহাঙ্গীর নামে এক যুবক নিহত হন। র‌্যাবের দাবি, জাহাঙ্গীর একজন মাদক কারবারি। ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার রত্নাপালং ইউনিয়নের করইবুনিয়া পাহাড়ের সীমান্তবর্তী এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সঙ্গে মাদক কারবারীদের গোলাগুলিতে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।

এর আগে গত ৩১ জুলাই দিবাগত রাতে গাজীপুরের শ্রীপুরে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একাধিক মামলার আসামি মো. পারভেজ (২৮) নিহত হন। কক্সবাজার টেকনাফের দমদমিয়া এলাকায় ব্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নুরুল হক ওরফে নুরু ডাকাত (৪৫) নিহত হন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যা মামলার আসামি কাজল (৪৮) নিহত হন। অন্যদিকে ঢাকার কেরাণীগঞ্জে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ২৫ ও ৩০ বছর বয়সী অজ্ঞাতনামা দুই তরুণ।

এছাড়া কক্সবাজার টেকনাফের হোয়াইক্যং ও টেকনাফের বিজভীখাল এলাকায় বিজিবির সঙ্গে মাদক কারবারিদের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মীর কাসেমকে (২৫) গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক করে এবং আরেকজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নদীর স্রোতে তলিয়ে যান। এমএসএফের প্রতিবেদন বলছে, প্রতিটি ঘটনাতেই র‌্যাবের দাবি, মৃত ব্যক্তিরা সন্ত্রাসী ছিল।

ওই প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, নির্যাতন ও বিক্ষোভে দমনে বল প্রয়োগের অভিযোগের সংখ্যাও প্রকাশ করা হয়েছে। চলতি মাসে পুলিশ হেফাজতে এক জন, নির্যাতনের ফলে এক জন ছাড়াও এক জন ছাত্রকে বাসা থেকে তুলে নেওয়া ও বিক্ষোভ দমনে বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটেছে।

সেপ্টেম্বরে কারা হেফাজতে যে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার আসামি আনিসুল ইসলাম রাজা (৪২)। আগস্টের মাঝামাঝি টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দিলে ১৮ আগস্ট থেকে ঢাকা কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের অধীনে মিডফোর্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ফজলুর রহমান তন্ময় ওরফে তাপস অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে কারা হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে গাজীপুর শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঢাকা কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের কারাবন্দি মো. খোরশেদ আলম (৬০) অসুস্থ হয়ে পড়লে কারারক্ষীরা তাকে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কারা হেফাজতে মো. আশরাফুল ইসলাম (৩৫) নামে এক হাজতির মৃত্যু হয়েছে। বুকে ব্যথা অনুভব করলে তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এছাড়া গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আবুল বাশার শামীম (৪৯) নামে এক কয়েদিকে অচেতন অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

অন্যদিকে আগস্ট মাসে যে পাঁচ জন কারা হেফাজতে মারা গেছেন তাদের মধ্যে একজন নারী, বাকি চার জন পুরুষ। এর মধ্যে ৪ আগস্ট সকালে গাজীপুর জেলা কারাগারের বন্দি আবদুর রহিম (৫৫) বুকে ব্যথা অনুভব করলে তাকে গাজীপুর শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। এদিকে, ১২ আগস্ট শ্বাসকষ্ট ও জ্বর নিয়ে চাঁদপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যান জেলা কারাগারের বন্দি উম্মে হাসিনা (৪১)। ১৪ আগস্ট সকালে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি লিয়াকত আলী (৭২)। পরে গাজীপুর শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

১৩ আগস্ট সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয় বার্ধক্যজনিত রোগসহ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মুজিবুর রহমান ওরফে আঙ্গুর মিয়ার (৭০)। তাকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সবশেষ ২৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে নেওয়া হয় জেলা কারাগারের কয়েদি আব্দুর রহমানকে (৫৪)। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

কারা হেফাজতে মৃত্যুর এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এমএসএফ জানিয়েছে, প্রতিমাসেই কারাগারের বন্দিদের মৃত্যু ঘটেছে বাইরের হাসপাতালগুলোতে, যা কারাগারগুলোর চিকিৎসাব্যবস্থার অপ্রতুলতা নির্দেশ করে। কারাগারগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নয়নের পাশাপাশি কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাগুলোর যথাযথ তদন্ত করে সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা উচিত।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!