বিশ্ব শুনেছে বাঘের গর্জন

যুব বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ

বাংলাদেশ তখন অনেকটা বিশ্বকাপ জয়ের দ্বারপ্রান্তে। যদিও সামান্য কিছুটা ঝুঁকিও ছিল। তারপরও বাংলাদেশের পাল্লা বেশি ভারি ছিল। এমন সময় বৃষ্টিতে হঠাৎ খেলা বন্ধ। পচেফস্ট্রমে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে তখন নানা নাটকীয়তা।

লক্ষ্য ১৭৮ রানের। বাংলাদেশের দরকার আর মাত্র ১৫ রান। হাতে আছে ৩ উইকেট। বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ হয়ে গেল। বাংলাদেশ নাকি ভারত, কার তাতে সুবিধা? বৃষ্টি আইনে (ডিএল পার স্কোর) বলছে, এই সময়ে ১৪৫ রান হলেই বাংলাদেশ জিতে যেত। সেই হিসেবে ৭ উইকেটে ১৬৩ রান করা বাংলাদেশ অনেকটা এগিয়ে। চ্যাম্পিয়ন হবে বাংলাদেশই।

ব্যাটের মাধ্যমে জয়ের গাঁথুনি গড়তে একটু পরেই বৃষ্টি থেমে গেল। নতুন লক্ষ্য দাঁড়ালো ১৭০, করতে হবে ৫ ওভারে অর্থাৎ ৩০ বলে। কিন্তু বাংলাদেশ ৭ বলেই জয়ের পতাকা উড়ায়। দলনায়ক আকবর আলী ৪৩ রানে অপরাজিত থেকে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়েন। নয় নম্বরে নামা রকিবুল হাসান অপরাজিত ছিলেন ৯ রানে, তারচেয়েও বড় কথা সে মোকাবেলা করেছে মহামূল্যবান ২৫টি বল।

বিশ্বসেরা হওয়ার প্রথম কাজটি করে রেখেছিলেন বাংলাদেশের বোলাররা। বাকি দায়িত্ব ছিল ব্যাটসম্যানদের। তারা কাজটি শুরুও করেছিলেন দারুণভাবে। বিনা উইকেটে ৫০ রান। সেই অবস্থান থেকে হঠাৎ করেই বাংলাদেশ যেন গড়িয়ে পড়ল! চোখের পলকেই যেন ৬৫ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে দিশেহারা বাংলাদেশ।

এই চার উইকেটের সবগুলোই শিকার করলেন একজন বোলার। রবি বিশ্নয়। ভারতীয় এই লেগস্পিনারের শুরুর ৫ ওভারের বোলিং বিশ্লেষণটা ছিল এমন; ৫-১-১২-৪!

ট্রফি জয়ের জন্য ১৭৮ রান তাড়ায় নামা বাংলাদেশের শুরুটা হলো দুর্দান্ত। ভারতের দুই পেসার কার্তিক ত্যাগী ও সুশান্তকে সহজেই খেলে দিলেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার তানজিদ হাসান ও পারভেজ হোসেন ইমন। মাত্র ৮.১ ওভারে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে জমা হল কোনো ক্ষতি ছাড়াই ৫০ রান। ভারত তাদের প্রথম ৮.১ ওভারে জমা করেছিল ১ উইকেটে মাত্র ১৫ রান। কিন্তু এত ভালো শুরু করার পরও বাংলাদেশ সেটা ধরে রাখতে পারল না। উইকেট পড়ছে না দেখে ভারত অধিনায়ক ৯ নম্বর ওভারে এসে কৌশল বদলে ফেলেন।

আক্রমণে স্পিন আনলেন। এবং রবি বিশ্নয়ের সেই ওভারের দ্বিতীয় বলেই তানজিদ হাসান তামিম হাঁটুগেড়ে মিড-উইকেট দিয়ে বিশাল ছক্কা হাঁকালেন। সেই ছক্কা তানজিদকে একটু অতিমাত্রায় উচ্চাভিলাসিতায় ডোবাল! বিশ্নয়ের ওভারের পঞ্চম বলে আরেকটি ছক্কা হাঁকানোর লোভে পেয়ে বসল তাকে। সেই লোভেই উইকেট হারালেন তানজিদ। বলা যায় উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এলেন!

বিশ্নয় তার তৃতীয় ওভারে এসে ফেরাল সেমিফাইনালে বাংলাদেশের জয়ের নায়ক মাহমুদুল হাসান জয়কে। বিশ্নয়ের গুগলি বুঝতেই পারেননি জয়। ১২ বলে ৮ রান করে ফিরেন তিনি। ৬২ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারায় বাংলাদেশ। সমস্যা আরো বাড়ল খানিকবাদে পিঠের চোট নিয়ে যখন মাঠ ছাড়তে বাধ্য হলেন ওপেনার পারভেজ হোসেন ইমন।

উইকেটে তখন বাংলাদেশের নতুন দুই ব্যাটসম্যান। আর বল হাতে রবি বিশ্নয়কে তখন উইকেট শিকারের নেশা যেন পেয়ে বসেছে। বিশ্নয়ের ফুল লেংথে পড়া বল তৌহিদ হৃদয় পেছনের পায়ে খেলতে গিয়ে বিপদকে ডেকে আনেন। বল তার পেছনের পায়ে লাগে। পরিষ্কার এলবি।

বিশ্নয়ের পঞ্চম ওভারে শাহাদাত কি খেলতে গেলেন, সেটা বোঝা মুশকিল! বল মিস করলেন। কিন্তু ক্রিজে পা নিতে একটু দেরি করে ফেললেন। বিদ্যুৎগতিতে সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্ট্যাম্পি করলেন উইকেটকিপার জুুরেল।

পেসার সুশান্ত মিশ্র তার দ্বিতীয় স্পেলের প্রথম বলেই এসে বাংলাদেশের ইনিংসে বড় ধাক্কা দিলেন। ব্যাটসম্যান শামীম হোসেন যে কায়দায় শটস খেললেন সেটাকে শট নয়, ‘আত্মহত্যা’ বলে! ১৮ বলে ৭ রান করে শামীম দলের সমস্যা বাড়িয়ে ফিরলেন।

বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডের চেহারা তখন ২০.১ ওভারে ৮৫ রানে ৫ উইকেট!

হাত বাড়ানো দূরত্বে থাকা বিশ্বকাপ ট্রফিকে তখন হঠাৎ অনেক দূরের অলীক বস্তু মনে হচ্ছিল! কিন্তু দলনেতা আকবর ও চট্টগ্রামের ছেলে ইমন ইনজুরি নিয়ে নেমে দলকে জয়ের কাছাকাছি নিয়ে যান। ইমন দলীয় সর্বোচ্চ ৪৭ রানে আউট হয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন আকবর।

বিশ্ব শুনেছে বাঘের গর্জন 1
যুবদের বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের ব্যাটিং লাইন ধসিয়ে দেয়ার নেতৃত্ব দেন শরীফুল। পরে ব্যাটসম্যানদের দৃঢ়তায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ

এর আগে টসে জিতে ভারতকে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানায় বাংলাদেশের অধিনায়ক আকবর আলী। ইনিংসের প্রথম ওভার থেকে বাংলাদেশ প্রচণ্ড চাপে রাখে ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের। মাঝেও ঠিক সেই চাপ রইল। আর শেষে এসে ভারত সেই চাপেই যেন ভেঙ্গে পড়ল। ফাইনালে থেমে গেল ভারতের ইনিংস ১৭৭ রানে। পুরো ওভারও খেলতে পারল না গেলবারের চ্যাম্পিয়নরা। ১৭৮ রান করতে পারলেই বাংলাদেশ হবে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের নতুন চ্যাম্পিয়ন!

টসে জিতে ম্যাচের প্রথম ওভার থেকেই বাংলাদেশ দুর্দান্ত বোলিং করে। মেঘলা আবহাওয়ায় পেস সহায়ক উইকেটে বাংলাদেশের পেসারদের সামনে অসহায় হয়ে পড়ে ভারতের ব্যাটিং লাইন-আপ। ৯ রানে প্রথম উইকেট হারানোর পর ভারত রক্ষণাত্মক ব্যাটিংয়ের দিকে মনোযোগ দেয়। উইকেট যাতে না হারায় সেই পরিকল্পনা নিয়ে ব্যাটিং শুরু করে। লম্বা সময় ধরে উইকেট ঠিকই অক্ষত রাখে ভারত। কিন্তু স্কোরবোর্ডে রানের স্বাস্থ্য ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে!

প্রথম ২৮ ওভারেও ভারতের স্কোরবোর্ডে একশ রান পুরো হলো না! ধীরগতির এই ব্যাটিং ভারতকে বড় চাপে ফেলে। ওপেনার যশপাল এবং ওয়ান ডাউনে তিলক বর্মা ছাড়া বলার মতো আর কোনো ব্যাটসম্যান রান পেলেন না। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ৯৪ রান যোগ করে ভারত। আর কোনো জুটিতে বড় রান হলো কই?

ওপেনার যশপাল ১২১ বলে করলেন ৮৮ রান। তিলক বর্মার ব্যাট থেকে এলো ৬৫ বলে কষ্টকর ৩৮ রানের ইনিংস।

বাংলাদেশের তিন পেসার শরিফুল, তানজিম ও অভিষেক দাস পুরো ইনিংস জুড়ে দুর্দান্ত বোলিং করে গেলেন। অভিষেক দাস ৪০ রানে শিকার করলেন ৩ উইকেট। শরিফুল ১০ ওভারে ৩১ রানে তুলে নিলেন ৩১ রান। ফাইনালে নিজেকে মেলে ধরলেন তানজিম হাসান সাকিবও। ২৮ রানে তার শিকার ২ উইকেট।

দুর্দান্ত বোলিং, দুরন্ত ফিল্ডিং এবং জেতার জেদ-এই তিনের সমন্বয়ে বাংলাদেশ মাত্র ১৭৭ রানে ভারতকে আটকে দিয়ে এখন বিশ্বকাপ জেতার রঙিন স্বপ্ন তৈরি করেছিল বোলাররা। যার শেষটা সমর্থকদের টেনশন বাড়িয়ে দিয়ে দারুণভাবে রাঙালেন দলরর ব্যাটসম্যানরা।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!