বিশ্বজুড়ে দেড় কোটি মানুষের ভাষা চাটগাঁইয়া, শীর্ষতালিকায় ৮৮তম

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা ছবির স্বীকৃতি পাওয়া ‘ন ডরাই’ নির্মিত হয় চট্টগ্রামের ভাষায়। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য ঢাকার মেয়ে নায়িকা সুনেরাহ বিনতে কামালকে শিখতে হয়েছিল চট্টগ্রামের ভাষা। ‘শেখার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে’— এমন কথা কবুল করে নিলেও তার মতোই অনেকের কাছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা রীতিমতো ‘দুর্বোধ্য’।

চট্টগ্রামের ভাষা সহজে বুঝতে না পেরে লেখক-প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে, নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে।’ আবার উল্টোপিঠে ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ এনামুল হকের অভিমত— ‘চট্টগ্রামের ভাষা বাংলার বিকৃতি নয়, এক ধরনের বিকাশ, ইহাও বাংলা বিশেষ।’

যা হোক, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা অনেকের কাছেই ‘দুর্বোধ্য’ মনে হলেও বিশ্বজুড়ে ‘চাটগাঁইয়া’ ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা যে কম নয় সেটা উঠে এসেছে ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্টের প্রতিবেদনে।

২০২০ সালে কানাডাভিত্তিক ওয়েবসাইট ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্টে প্রকাশিত বিশ্বের ১০০টি কথ্য ভাষার তালিকায় স্থান পেয়েছে চাঁটগাঁইয়া ভাষা। এটি পৃথিবীর ৮৮তম বৃহত্তম ভাষা ও বাংলাদেশে আঞ্চলিক ভাষার দিক দিয়ে প্রথম বৃহত্তম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

গবেষণাধর্মী ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ চাটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলেন। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কথা বলা হয় যেসব ভাষায় তার তালিকা তৈরি করেছে ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট নামের এই ওয়েবসাইট।

কানাডাভিত্তিক ওই ওয়েবসাইটটির প্রকাশিত তালিকার শীর্ষস্থানে রয়েছে ইংরেজি। ১১৩ কোটি ২৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬৮০ জন এ ভাষায় কথা বলেন। ১১১ কোটি ৬৫ লাখ ৯৬ হাজার ৬৪০ ভাষাভাষী মানুষ নিয়ে তালিকার দ্বিতীয় স্থানটি মান্দারিন চাইনিজের। ভারতের অন্যতম প্রধান ভাষা হিন্দির স্থান তৃতীয়। এই ভাষায় কথা বলেন ৬১ কোটি ৫৪ লাখ ৭৫ হাজার ৫৪০ জন। এরপর স্প্যানিশ, ফরাসি ও আরবির পর ভাষাভাষীর দিক দিয়ে বাংলা পৃথিবীর সপ্তম বৃহৎ মাতৃভাষা। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মানুষের প্রধান ভাষা বাংলা; এ ভাষার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২৬ কোটি ৫০ লাখ ৪২ হাজার ৪৮০। সেরা ১০০ ভাষার তালিকায় এক কোটি ১৮ লাখ ভাষাভাষী নিয়ে সিলেটি ভাষা রয়েছে ৯৭তম স্থানে।

চাঁটগাঁইয়া বা চিটাইঙ্গা হল ইন্দো-আর্য ভাষাগোষ্ঠির একটি সদস্য ভাষা এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা। চাটগাঁইয়া বুলির নিজস্ব কোনো অক্ষর না থাকায় এ ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে বাংলা অক্ষরে আঞ্চলিক ভাষায় লিখতে দেখা যায় সামাজিক মাধ্যমগুলোতে।

ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ইন্দো-আর্য শাখার পূর্বাঞ্চলীয় ইন্দো-আর্যের উপশাখা বাংলা-অসমীয়ের সদস্য হল চাঁটগাঁইয়া ভাষা। এই ভাষার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রয়েছে সিলেটি, রোহিঙ্গা, বাংলা, অসমীয়া, ওড়িয়া এবং বিহারি ভাষার। তাছাড়া ইন্দো-আর্যের হিন্দির সাথে চাঁটগাঁইয়ার পরোক্ষ মিল রয়েছে। অন্যান্য বাংলা-অসমীয়া ভাষাসমূহের মত চাঁটগাঁইয়া পালি ভাষা থেকে এসেছে— যা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের একটি কল্পিত পূর্বসূরী প্রত্ন-ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার উত্তরসূরী।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল প্রধানত চট্টগ্রামের চট্টগ্রাম জেলা এবং কক্সবাজার জেলার মানুষেরা চাঁটগাঁইয়া ভাষায় কথা বলে।

চাঁটগাঁইয়া ভাষায় ব্যাকরণের ব্যবহার বাংলা ভাষার অনুরুপ তবে উপসর্গ, অনুসর্গ এবং অন্যান্য উপায়ে শব্দের কলেবর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য রয়েছে। যেমন— কাজটি গতকাল করেছি >হাম ইয়ান গত হালিয়া গইজ্জি/গইরগি, কাজটি এখন করতেছি >হাম ইয়ান ইয়া গরির, কাজটি আগামিকাল করব >হাম ইয়ান আয়েদ্দে হাইল্লা গইজ্জুম/গইরগুম ইত্যাদি।

চাঁটগাঁইয়া ভাষার শব্দ বিন্যাস বা বাক্যগঠন হয় কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া ধারায়। যেমন— ইঁতারা(তারা) হাঁমত(কাজে) যার গুঁই(যায়)।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!