বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন মেয়র রেজাউল নিজেই, সমালোচনার ঝড় চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ছাড়াও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন স্পষ্ট করেই জানালেন, চট্টগ্রামের সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীকে নগর আওয়ামী ইউনিট সম্মেলনের বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে গঠিত ‘রিভিউ কমিটি’র সমন্বয়ক কিংবা প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্বই দেওয়া হয়নি। রোববার (১৬ জানুয়ারি) ঢাকায় অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত থাকা একাধিক নেতাও জানিয়েছেন, ৬ সদস্যের কমিটিতে রেজাউলকে রাখা হলেও তাকে দেওয়া হয়নি আলাদা কোনো দায়িত্ব।

এরপরও চট্টগ্রামের সিটি মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী কেন ঘটা করে বানোয়াট তথ্য প্রচার করতে গেলেন— এ নিয়ে চট্টগ্রামের স্থানীয় রাজনৈতিক মহলে উঠেছে আলোচনার ঝড়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে এ নিয়ে বক্রোক্তি কিংবা টিকা-টিপ্পনী করতেও ছাড়ছেন না।

রোববার (১৬ জানুয়ারি) ঢাকার বৈঠক শেষে চট্টগ্রামে ফিরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন রেজাউল করিম। সেখানে বৈঠকের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে নিজেকে ‘রিভিউ কমিটির প্রধান’ হিসেবে দাবি করে তিনি বলেন, ‘নগর আওয়ামী লীগের যেসব ইউনিটে সম্মেলন হয়েছে সেগুলো নিয়ে প্রচুর অভিযোগ। এই অনিয়মের অভিযোগগুলো তদন্তপূর্বক পুনঃবিবেচনার জন্য কেন্দ্র আমার নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি রিভিউ কমিটি গঠন করে দিয়েছে। আমরা ৬ জন আগামী শুক্রবার বিকালে আমার বাসায় বসবো।’

শুধু তাই নয়, রেজাউলের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজেও নিজেকে তিনি ‘রিভিউ কমিটির প্রধান’ হিসেবে দাবি করেছেন। অথচ ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ছাড়াও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমন তথ্য শুনে খোলাখুলি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

সোমবার (১৭ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সঙ্গে ফোনে আলাপকালে মাহবুবউল আলম হানিফ বিস্ময়ের সঙ্গে বলেন, ‘রেজাউলকে কেন প্রধান সমন্বয়ক করা হবে? নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কি নেই?’

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম সম্পাদক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে নিশ্চিত করে বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের রিভিউ কমিটিতে কাউকে আহবায়ক কিংবা প্রধান সমন্বয়ক করা হয়নি। রিভিউ কমিটি চলবে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব ভাইয়ের পরামর্শে। এতে সহযোগিতা দেবে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ বাকি ৪ সিনিয়র নেতা। বেশি অভিযোগ আসা ইউনিট কমিটির বিষয়াদি সমাধানেই এই রিভিউ কমিটি।’

শুধু ‘প্রধান সমন্বয়কের’ কথিত দায়িত্ব নিয়েই নয়, সিটি মেয়র রেজাউল বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন ওয়ার্ড সম্মেলন নিয়েও। রোববার গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে রেজাউল জানান, ‘চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সম্মেলন আপাতত হবে না।’

সোমবার সন্ধ্যায় এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই আরেক দফা বিস্ময় প্রকাশ করলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বললেন, ‘কী বলেন? নগরের ওয়ার্ড কমিটির সম্মেলন বন্ধ থাকার জন্যই কি (ঢাকায়) এই সভা হয়েছে? কে কী বললেন এসব দেখার বিষয় না। বাকি ইউনিটগুলোর সম্মেলন শেষে ওয়ার্ড সম্মেলন হতেই হবে।’

সিটি মেয়রের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে রেজাউল করিম চৌধুরী কেন এমন বানোয়াট তথ্যের আশ্রয় নিলেন— এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে। অনেকে খোলাখুলিই তার রাজনৈতিক ম্যাচিউরিটি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। ঢাকার বৈঠকে ‘সুবিধা’ করতে না পেরে রেজাউলের মুখে এমন কথা গুঁজে দিয়ে একটি পক্ষ নিজেদের বলয়ের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে চেয়েছে।

আ জ ম নাছির উদ্দীন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র থাকাকালে বিভিন্ন বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরাগভাজন হন। চট্টগ্রাম সিটির সর্বশেষ নির্বাচনে সে কারণে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তখন হঠাৎ করেই মেয়র হিসেবে মনোনয়ন পেয়ে নিভৃতে থাকা রেজাউল করিম চৌধুরী আলোচনায় চলে আসেন।

যদিও এখন পর্যন্ত দলে তার নিজস্ব কোনো প্রভাব বা বলয় নেই। তবে তার সাম্প্রতিক তৎপরতায় নেতাকর্মীদের ধারণা, তিনি মহিউদ্দিন চৌধুরী পুত্র মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের বলয়ে ভিড়েছেন।

গত রোববার (১৬ জানুয়ারি) সকাল ১০টায় ঢাকার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দলীয় কার্যালয়ে নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে ‘নালিশী বৈঠক’ শেষ হয় ইউনিট কমিটি গঠন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে। ইউনিট সম্মেলনকে কেন্দ্র করে হঠাৎ করে বিরোধে জড়িয়ে যাওয়া চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে রাজধানীতে বসার সিদ্ধান্ত নেন চট্টগ্রাম নগরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। এই সভা ঘিরে চট্টগ্রামে দফায় দফায় গোপন বৈঠক, কথার যুদ্ধ চলে আসলেও শেষ পর্যন্ত ঢাকার বৈঠকটি অনেকটাই ‘সান্ত্বনার সভা’য় রূপ নেয়।

চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। সভা পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, অর্থ সম্পাদক ওয়াসিকা আয়শা খান, নগরের বন্দর আসনের সাংসদ এমএ লতিফ, কোতোয়ালী আসনের সাংসদ ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, নগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু, সহ সভাপতি এডভোকেট সুনীল সরকার, জহিরুল আলম চৌধুরী দোভাষ ডলফিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রামের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম।

ঢাকার ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়— চট্টগ্রাম মহানগরের আওতাধীন যে সমস্ত ইউনিটের সম্মেলন ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে সে সকল ইউনিটগুলোতে অনিয়ম থাকলে রিভিউ কমিটির মাধ্যমে সংশোধন করা হবে।

নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে এই রিভিউ কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ এবং চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি নঈম উদ্দিন চৌধুরী।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!